ফুটবল

মেসির জোড়া গোল ও অ্যাসিস্টে ইতিহাস, সেমিফাইনালে ইন্টার মায়ামি

Advertisement

মেসির জাদুতে ভেসে গেল ন্যাশভিল, সেমিফাইনালে মায়ামি

লিওনেল মেসি মানেই যেন এক অন্য গ্রহের ফুটবল। বয়স পেরিয়েছে ৩৮, কিন্তু মাঠে তার পায়ের জাদু এখনও আগের মতোই ঝলমলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকারে (এমএলএস) আবারও সেটিই প্রমাণ করলেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি।

দুই ম্যাচে সমতায় থাকা ইন্টার মায়ামি ও ন্যাশভিলের তৃতীয় লেগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভাগ্য নির্ধারণী। এই ম্যাচে মেসির নেতৃত্বে ইন্টার মায়ামি যেন ফুটবলের কবিতা লিখল মাঠে। জোড়া গোল ও জোড়া অ্যাসিস্টে তিনি শুধু জয়ের পথই দেখাননি, নিজের নামও লিখিয়েছেন নতুন এক রেকর্ডে। ন্যাশভিলকে ৪–০ গোলে উড়িয়ে প্রথমবারের মতো এমএলএস কাপ প্লে–অফের সেমিফাইনালে উঠেছে মায়ামি।

মেসির জোড়া গোল, জোড়া অ্যাসিস্টে রেকর্ড

শনিবারের ম্যাচে মেসির পারফরম্যান্স ছিল এককথায় অসাধারণ। পুরো ৯০ মিনিট মাঠে যেন তিনিই ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। প্রথমার্ধে দুটি গোল, দ্বিতীয়ার্ধে দুটি অ্যাসিস্ট—সব মিলিয়ে ইতিহাস গড়লেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক।

এই ম্যাচের মাধ্যমে ক্লাব ও আন্তর্জাতিক ফুটবল মিলিয়ে ৪০০ অ্যাসিস্টের মাইলফলক স্পর্শ করলেন মেসি—যা ফুটবল ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

তার এই ৪০০ অ্যাসিস্ট এসেছে চারটি দলে খেলে:

  • বার্সেলোনার হয়ে: ২৬৯ অ্যাসিস্ট
  • আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে: ৬০ অ্যাসিস্ট
  • প্যারিস সাঁ জার্মেই (পিএসজি)-এর হয়ে: ৩৪ অ্যাসিস্ট
  • ইন্টার মায়ামির হয়ে: ৩৭ অ্যাসিস্ট

এই রেকর্ডের পাশাপাশি মেসি ন্যাশভিলের বিপক্ষে নিজের গোলসংখ্যা বাড়িয়ে নিলেন ১৫-তে—যা এমএলএস ইতিহাসে এক প্রতিপক্ষের বিপক্ষে তার সর্বোচ্চ গোল।

প্রথমার্ধেই দুই গোল, মেসির একক দাপট

ইন্টার মায়ামির গুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচে লুইস সুয়ারেজ ছিলেন না ইনজুরির কারণে। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতেও আক্রমণে ঘাটতি দেখা যায়নি। কারণ সামনে ছিলেন লিওনেল মেসি।

ম্যাচের মাত্র ১০ মিনিটেই মায়ামিকে এগিয়ে দেন এই আর্জেন্টাইন সুপারস্টার। ইয়ান ফ্রের প্রেসিংয়ে ন্যাশভিল ডিফেন্ডার ম্যাথিউ করকোরানের ব্যাকপাস ভুলে পড়ে যায় আলেন্দের পায়ে। তিনি এক টাচে বল বাড়িয়ে দেন মেসির পথে। সামনে ফাঁকা জায়গা পেয়ে মেসি ঠান্ডা মাথায় ২০ গজ দূর থেকে নিচু শটে বল জাল খুঁজে নেন।

৩৯তম মিনিটে আবারও গোল করেন তিনি। এবার জর্দি আলবার দীর্ঘ পাস ক্লিয়ার করতে ব্যর্থ হন ওয়াকার জিমারম্যান। সেই বল থেকে মাতোও সিলভেত্তির নিখুঁত পাসে দৌড়ে গিয়ে মেসি গোলকিপারকে পরাস্ত করেন অনায়াসে।

প্রথমার্ধ শেষ হয় মায়ামির ২–০ লিডে। দর্শকরা তখনই বুঝে যান, এই রাত মেসির।

দ্বিতীয়ার্ধে আরও দুই গোল, মেসির পায়ে ইতিহাস

দ্বিতীয়ার্ধে ন্যাশভিল একবার গোল পেলেও রেফারি ফাউলের কারণে সেটি বাতিল করে দেন। এরপরই ম্যাচে ফিরে আসে ইন্টার মায়ামির আগ্রাসী রূপ।

৭৩ ও ৭৬ মিনিটে পরপর দুটি গোল করেন আলেন্দে। দুটি গোলই আসে মেসির নিখুঁত অ্যাসিস্ট থেকে। প্রথমটিতে মিডফিল্ড থেকে ডিফেন্স ভেদ করা এক চমৎকার থ্রু বল দেন মেসি, যা থেকে আলেন্দে ঠান্ডা মাথায় ফিনিশ করেন। দ্বিতীয়টিতে কর্নার থেকে মেসির নিখুঁত ক্রস হেড করে জালে পাঠান আলেন্দে।

এতেই নিশ্চিত হয় ৪–০ গোলের বিশাল জয় এবং মায়ামির ইতিহাস গড়া সেমিফাইনাল।

মেসির নেতৃত্বে ইন্টার মায়ামির নতুন অধ্যায়

মায়ামির কোচ হাভিয়ের মাসচেরানো ম্যাচ শেষে বলেন,

“মেসির মতো খেলোয়াড়কে নিয়ে কোচিং করা যেন স্বপ্নের মতো। সে শুধু গোল করছে না, বরং দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে।”

২০২৩ সালে এমএলএসে অভিষেক হওয়ার পর থেকেই মেসির আগমন ইন্টার মায়ামির ভাগ্য বদলে দিয়েছে। তার আগে এই দল ছিল লিগের তলানিতে। কিন্তু এখন তারা লিগের অন্যতম শক্তিশালী দল।

মেসি যোগ দেওয়ার পর থেকে মায়ামি ৩৭ ম্যাচে মাত্র ৬টিতে হেরেছে, বাকি ম্যাচে জয় বা ড্র। তিনি খেললে দলের জয়ের হার প্রায় ৭৫ শতাংশ, যা ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোর সাথেও পাল্লা দেয়।

সিনসিনাটির মুখোমুখি সেমিফাইনালে

এই জয়ে ইন্টার মায়ামি প্রথমবারের মতো এমএলএস কাপ প্লে-অফের সেমিফাইনালে উঠেছে। সেমিতে তাদের প্রতিপক্ষ হবে এফসি সিনসিনাটি—যারা এই মৌসুমে দুর্দান্ত ফর্মে আছে।

সিনসিনাটির বিপক্ষে মেসির অভিজ্ঞতা অবশ্য ভালো। গত মৌসুমে দুই দলে মুখোমুখি লড়াইয়ে মেসি গোল ও অ্যাসিস্ট মিলিয়ে সরাসরি তিনটি অবদান রাখেন। তাই সেমিফাইনালেও তাকে আটকানোই এখন সিনসিনাটির প্রধান চ্যালেঞ্জ।

মেসি বনাম সময়: ফুটবলের এক অদম্য গল্প

বয়সের ভারে অনেকেই যখন গতি হারান, তখন মেসি যেন আরও পরিণত হয়ে উঠছেন। ইউরোপ ছেড়ে আমেরিকার মাঠে পা রেখেও তার পায়ের জাদু কমেনি বিন্দুমাত্র। বরং যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে তিনি আবারও দেখাচ্ছেন, কেন তাকে “ফুটবলের রাজা” বলা হয়।

বিশ্বকাপ জয়ের পর থেকেই তার প্রতিটি ম্যাচ যেন ফুটবলপ্রেমীদের জন্য উৎসব। ইন্টার মায়ামির জার্সিতে মেসি এখন পর্যন্ত খেলেছেন ৫৬ ম্যাচে, করেছেন ৪৫ গোল ও ৩৭ অ্যাসিস্ট। অর্থাৎ প্রতি ম্যাচে তিনি দলের অন্তত এক গোলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।

ভক্তদের উন্মাদনা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড়

মেসির এই ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্সের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় উন্মাদনা। টুইটার (এক্স), ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকে ভক্তরা মেসিকে “GOAT” বা সর্বকালের সেরা আখ্যা দিয়ে পোস্টে ভরিয়ে দেন।

ম্যাচ শেষে মেসিও তার ইনস্টাগ্রামে লেখেন,

“দল হিসেবে আমাদের লক্ষ্য ছিল সেমিফাইনাল, এখন সেটি পেরিয়ে ফাইনাল জয়ের দিকে নজর। সবাইকে ধন্যবাদ এই সমর্থনের জন্য।”

মেসির প্রভাব ও এমএলএসের জনপ্রিয়তা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেসির কারণে এমএলএস-এর দর্শকসংখ্যা ও জনপ্রিয়তা বেড়েছে অভূতপূর্ব হারে। ২০২৪ সালের তুলনায় এই মৌসুমে দর্শকসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। টিভি রেটিংও দ্বিগুণ হয়েছে, যা সরাসরি মেসির প্রভাব।

এছাড়া মেসির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল বাজারে বিনিয়োগ বেড়েছে, নতুন স্পনসর এসেছে, এবং মায়ামির জার্সি বিক্রি এখন রেকর্ড উচ্চতায়।

ইন্টার মায়ামির জার্সিতে লিওনেল মেসি শুধু একজন ফুটবলার নন, তিনি এক অনুপ্রেরণা। তার জোড়া গোল ও অ্যাসিস্টে দল ইতিহাস গড়েছে, আর তিনি নিজে লিখেছেন ফুটবলের নতুন অধ্যায়।

সামনে সেমিফাইনাল—আরও একবার সারা দুনিয়ার চোখ থাকবে মেসির দিকে। দেখার বিষয়, তিনি কি আবারও তার জাদু দেখিয়ে মায়ামিকে ফাইনালে তুলতে পারেন কি না।

MAH – 13684 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button