
বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও গভীর ও কার্যকর করতে ভুটান একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (Free Trade Agreement – FTA) স্বাক্ষরে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ড. শেরিং টোবগে জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে এই প্রস্তাব দেন।
টোবগে জানান, ভুটানের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গেলেফু মাইন্ডফুলনেস সিটি (Gelephu Mindfulness City – GMC) সরাসরি বাংলাদেশের কুড়িগ্রামে স্থাপিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত হলে উভয় দেশই বিপুলভাবে উপকৃত হতে পারে। এতে শুধু পণ্য বাণিজ্য নয়, বিনিয়োগ, শিল্প স্থাপন, পর্যটন ও সাংস্কৃতিক বিনিময়—সব ক্ষেত্রেই নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
বাংলাদেশ-ভুটান সম্পর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের সঙ্গে ভুটানের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয় ভুটান। সেই থেকে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিভিন্ন সময়ে বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়েছে।
২০১৪ সালে বাংলাদেশ-ভুটানের মধ্যে একটি ট্রেড অ্যান্ড ট্রানজিট এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়, যার ফলে সীমিত আকারে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়। বর্তমানে দুই দেশের বার্ষিক বাণিজ্য প্রায় ৫০-৬০ মিলিয়ন ডলারের মতো হলেও তা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে ভুটানে ওষুধ, তৈরি পোশাক, খাদ্যপণ্য, পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি হয়। অপরদিকে ভুটান থেকে বাংলাদেশে প্রধানত পাথর, কাঠ, ফলমূল ও কিছু কৃষিপণ্য আসে।
এবারের প্রস্তাবিত এফটিএ হলে বাণিজ্য আরও বাড়বে এবং বিনিয়োগের নতুন সুযোগ তৈরি হবে।
গেলেফু মাইন্ডফুলনেস সিটি: ভুটানের নতুন অর্থনৈতিক ভিশন
ভুটান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে “গেলেফু মাইন্ডফুলনেস সিটি” গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এটি এক ধরনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, যেখানে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ, প্রযুক্তি হাব, পর্যটন কেন্দ্র এবং সবুজ জ্বালানিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম অঞ্চলে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বরাদ্দ রয়েছে। ভুটান চায় সরাসরি এই দুই অর্থনৈতিক অঞ্চলকে সড়কপথে বা আঞ্চলিক যোগাযোগের মাধ্যমে যুক্ত করতে। এর ফলে ভুটান ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে সহজেই বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারবে।
প্রফেসর ইউনূসের প্রতিক্রিয়া
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভুটানের এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এবং ভুটান উন্নত যোগাযোগ, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এক নতুন স্তরে নিয়ে যেতে পারে। এই সুযোগকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে।”
ইউনূস আরও উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প, আইসিটি খাত এবং তৈরি পোশাক শিল্প ভুটানের বাজারে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
ভুটানের আগ্রহের ক্ষেত্রসমূহ
১. ধর্মীয় পর্যটন: ভুটান চায় বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি পর্যটক আকর্ষণ করতে। বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য ভুটানকে এক আধ্যাত্মিক গন্তব্য হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা অতীতে ভুটানে ধর্ম প্রচার করেছিলেন—এ ইতিহাসকে আরও জোরালোভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে।
২. জলবিদ্যুৎ রপ্তানি: ভুটান হিমালয়নির্ভর জলবিদ্যুৎ সমৃদ্ধ দেশ। দেশটির উৎপাদিত বিদ্যুতের বড় অংশ বর্তমানে ভারতে রপ্তানি হয়। এবার তারা বাংলাদেশের সঙ্গেও এ বিদ্যুৎ ভাগাভাগি করতে আগ্রহী। এতে বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সহায়তা মিলবে।
৩. ওষুধশিল্পে বিনিয়োগ: বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী খাত। ভুটান চায় এ খাতে বাংলাদেশি কোম্পানির বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে। এতে ভুটানের ওষুধ খাতের ঘাটতি পূরণ হবে, আবার বাংলাদেশি কোম্পানির জন্য নতুন বাজার সৃষ্টি হবে।
৪. ফাইবার অপটিক সংযোগ: ভুটান তাদের তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো উন্নত করতে চায়। এজন্য তারা বাংলাদেশের সহায়তায় ফাইবার অপটিক সংযোগ স্থাপন করতে আগ্রহী। এর ফলে ডিজিটাল কানেক্টিভিটি আরও বাড়বে।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা
বৈঠকে দুই নেতা রোহিঙ্গা ইস্যুতেও মতবিনিময় করেন। ভুটান মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানায়।
ভুটান প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা ও বাংলাদেশ সফরের পরিকল্পনা
প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা করে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান নেতৃত্বে দেশটি “ভালো হাতে” রয়েছে। তিনি প্রফেসর ইউনূসকে তার “রোল মডেল” এবং “আমার অধ্যাপক” বলে সম্বোধন করেন।
এছাড়া তিনি বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। আশা করা হচ্ছে, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচনের আগে তিনি বাংলাদেশ সফর করবেন।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশ-ভুটানের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হলে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বাণিজ্য কাঠামোতে নতুন গতি আসবে। বিশেষ করে বাংলাদেশ যদি ভুটানের জলবিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে এবং ভুটানের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বাংলাদেশি বিনিয়োগ বাড়ে, তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক কেবল অর্থনীতিতে নয়, কূটনীতিতেও শক্তিশালী হবে।
ভুটানের এফটিএ প্রস্তাব বাংলাদেশ-ভুটান সম্পর্কের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হতে পারে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পাশাপাশি ধর্মীয় পর্যটন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি খাত—সব ক্ষেত্রেই উভয় দেশের জন্য সম্ভাবনার দরজা খুলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ যদি এই সুযোগকে কাজে লাগায়, তবে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট হিমালয় দেশ ভুটান ও সমুদ্রবন্দরের দেশ বাংলাদেশ একসঙ্গে নতুন অর্থনৈতিক যাত্রায় পা রাখতে পারবে।
MAH – 13018 I Signalbd.com