১৭ বছর পর ফয়সালাবাদের মাঠে আবারও ক্রিকেটের উত্তাপ
১৭ বছর—একটি প্রজন্মের চেয়েও বড় সময়। এই দীর্ঘ বিরতির পর আবারও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরল পাকিস্তানের ঐতিহাসিক ফয়সালাবাদের ইকবাল স্টেডিয়ামে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচের পর এই মাঠে আর কোনো আন্তর্জাতিক লড়াই দেখা যায়নি। অবশেষে ২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তান বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার প্রথম ওয়ানডে দিয়ে শেষ হলো সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষা।
ফয়সালাবাদের আকাশে ছিল উৎসবের আমেজ, গ্যালারিতে হাজারো দর্শক, হাতে পতাকা, মুখে আনন্দের ঝলক। পাকিস্তান ক্রিকেটের জন্য এটি ছিল কেবল একটি জয় নয়—বরং এক ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তনের দিন।
ইকবাল স্টেডিয়ামে ক্রিকেটের নির্বাসন: কেন এত বছর বন্ধ ছিল খেলা
২০০৮ সালে যখন বাংলাদেশ সফরে গিয়েছিল পাকিস্তানে, তখনও বিশ্বজুড়ে পাকিস্তানকে ক্রিকেটের নিরাপদ ভেন্যু বলা হতো। কিন্তু ২০০৯ সালের মার্চে শ্রীলঙ্কান দলের ওপর লাহোরে সন্ত্রাসী হামলার পর এক দশকেরও বেশি সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নির্বাসনে চলে যায় দেশটি। বিদেশি দলগুলো নিরাপত্তা আশঙ্কায় পাকিস্তানে আসতে চাইত না।
ফয়সালাবাদের মতো ঐতিহ্যবাহী ভেন্যুগুলো তখন নীরব হয়ে পড়ে। যদিও পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রাণ ফিরিয়ে এনেছিল, আন্তর্জাতিক ম্যাচের আলো ছড়ায়নি ফয়সালাবাদের মাঠে।
অবশেষে ২০২৫ সালে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (PCB) নিরাপত্তা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত করে ফয়সালাবাদে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরিয়ে আনে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পাকিস্তানের নাটকীয় জয়
ইকবাল স্টেডিয়ামের প্রত্যাবর্তনের দিনে নাটক কম হলো না। প্রথম ওয়ানডেতে দক্ষিণ আফ্রিকার দেওয়া ২৬৪ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে পাকিস্তান জয় পেল ২ উইকেট হাতে রেখে, মাত্র ২ বল বাকি থাকতে।
ম্যাচের প্রথম ভাগে দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যাট করে গড়ে ২৬৩ রান। তাদের পক্ষে ডেভিড মিলার করেন ৭৮, আর হেনরিক ক্লাসেন যোগ করেন ৪৫ রান। পাকিস্তানের বোলারদের মধ্যে শাহিন শাহ আফ্রিদি ও নাসিম শাহ নেন দুটি করে উইকেট।
টার্গেট তাড়া করতে নেমে শুরুতেই পাকিস্তান কিছুটা ধাক্কা খায়। ইমাম-উল-হক ও বাবর আজমের দ্রুত আউট হয়ে যাওয়ায় স্কোরবোর্ডে চাপ তৈরি হয়। তবে মাঝের সারিতে দাঁড়ান মোহাম্মদ রিজওয়ান (৫৫) ও সালমান আলী আঘা (৬২)—দুজনের ব্যাটে ভর করে পাকিস্তান জয় নিশ্চিত করে।
শেষ মুহূর্তে খানিক নাটক অবশ্য হয়। হাতে ৬ উইকেট রেখে পাকিস্তানের দরকার ছিল ২৬ বলে ২৩ রান। কিন্তু টানা তিন উইকেট হারিয়ে ম্যাচে টান টান উত্তেজনা তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত নাসিম শাহ শান্তভাবে সিঙ্গেল নিয়ে পাকিস্তানের জয় নিশ্চিত করেন।
শাহিন আফ্রিদির অধিনায়কত্বে নতুন যুগের সূচনা
এই ম্যাচ ছিল পাকিস্তানের নতুন ওয়ানডে অধিনায়ক শাহিন শাহ আফ্রিদির প্রথম ম্যাচ। শুরুতেই জয় পেয়ে তিনি রীতিমতো উচ্ছ্বসিত। ম্যাচ শেষে তিনি বলেন,
“ফয়সালাবাদের দর্শকদের ধন্যবাদ জানাই। এত বছর পর এই মাঠে ক্রিকেট ফিরেছে, আর এত দর্শক এসেছে—এটা আমাদের জন্য দারুণ প্রেরণার।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“আমরা চাই পাকিস্তানের প্রতিটি শহরে আবারও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরুক। আজকের জয় সেই স্বপ্নের শুরু।”
শাহিনের নেতৃত্বে পাকিস্তান দল নতুন উদ্যমে খেলেছে—যা মাঠে এবং গ্যালারিতে উচ্ছ্বাস ছড়িয়েছে।
নতুন রেকর্ড: ফয়সালাবাদে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়
পাকিস্তানের এই জয় শুধু প্রতীকী ছিল না, ছিল পরিসংখ্যানেও স্মরণীয়। দক্ষিণ আফ্রিকার ২৬৪ রানের লক্ষ্য তাড়া করে জয় পেয়ে পাকিস্তান ভাঙল ফয়সালাবাদের সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড।
এর আগে এই মাঠে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয় এসেছিল ২০০৮ সালে, যখন পাকিস্তান জিম্বাবুয়ের ২৪৫ রান টপকে ৭ উইকেটে জয় পেয়েছিল। ১৭ বছর পর সেই রেকর্ড ভাঙল শাহিনদের পাকিস্তান দল।
দর্শক-উচ্ছ্বাসে মুখর ফয়সালাবাদ
ম্যাচটিকে ঘিরে ছিল সত্যিকার অর্থেই উৎসবের আবহ। গ্যালারিতে উপস্থিত ছিল প্রায় ১৭ হাজার দর্শক। অনেকেই এসেছিলেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, কেউ কেউ এমনকি লাহোর ও ইসলামাবাদ থেকেও এসেছেন শুধু ফয়সালাবাদে ক্রিকেট ফেরার সাক্ষী হতে।
স্টেডিয়ামের বাইরে ছিল ড্রাম, পতাকা, নাচ-গান—একটা উৎসবমুখর পরিবেশ। দর্শকদের হাতে লেখা পোস্টারগুলোয় ছিল বার্তা—“Welcome Back Cricket!” এবং “We Missed You Faisalabad!”
সালমান আলী আঘা: ম্যাচের সেরা
ম্যাচে ব্যাট হাতে ৭১ বলে ৬২ রান করে দলকে জেতানো সালমান আলী আঘা নির্বাচিত হন ম্যাচসেরা খেলোয়াড় হিসেবে। তাঁর ইনিংসে ছিল ৫টি চমৎকার চার ও ১টি ছক্কা।
পুরস্কার গ্রহণের সময় তিনি বলেন,
“আমি ছোটবেলায় এই মাঠে বাবার সঙ্গে খেলা দেখতে আসতাম। আজ এখানে আন্তর্জাতিক ম্যাচে খেলতে পারা—স্বপ্নের মতো। এই জয় ফয়সালাবাদের মানুষের জন্য।”
আগামী ম্যাচগুলোও ফয়সালাবাদে
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তিন ম্যাচ সিরিজের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওয়ানডেও অনুষ্ঠিত হবে ৬ ও ৮ নভেম্বর—দুটিই ফয়সালাবাদের ইকবাল স্টেডিয়ামে।
বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টায় শুরু হবে ম্যাচগুলো। এই দুটি ম্যাচের ফলাফলই নির্ধারণ করবে সিরিজের ভাগ্য। পাকিস্তান এখন ১–০ ব্যবধানে এগিয়ে।
পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পুনর্জাগরণ
ফয়সালাবাদে ক্রিকেট ফেরানো শুধু একটি শহরের অর্জন নয়; এটি পুরো পাকিস্তান ক্রিকেটের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার প্রতীক। গত এক দশকে ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরেছে দেশটিতে—লাহোর, করাচি, রাওয়ালপিন্ডি, মুলতান—এবার সেই তালিকায় যুক্ত হলো ফয়সালাবাদও।
২০২৫ সালে পাকিস্তান সুপার লিগের কয়েকটি ম্যাচ সফলভাবে আয়োজনের পরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফেরানোর অনুমতি মেলে। স্থানীয় প্রশাসন নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে, নতুন করে স্টেডিয়াম সংস্কার করা হয়, বসানো হয় উন্নত ফ্লাডলাইট ও ড্রেনেজ সিস্টেম।
ক্রিকেটপ্রেমীদের আশা: এবার যেন আর থেমে না যায় ক্রিকেট
ফয়সালাবাদবাসীর আশা, এবার যেন এই শহরের ক্রিকেট আবার থেমে না যায়। স্থানীয় তরুণ ক্রিকেটারদের কাছে এই ম্যাচ নতুন অনুপ্রেরণা হিসেবে এসেছে। অনেকেই বলছেন—
“এই ম্যাচ আমাদের দেখিয়েছে, ফয়সালাবাদও আবার পাকিস্তান ক্রিকেটের মানচিত্রে ফিরে এসেছে।”
ক্রিকেট কেবল খেলা নয়, আবেগের নাম
ফয়সালাবাদে ক্রিকেটের ফেরাটা শুধু একটি ম্যাচ নয়—একটি আবেগ, একটি ইতিহাস। ১৭ বছর আগে যেখানে বাংলাদেশ দল খেলেছিল, আজ সেখানে পাকিস্তান জয় তুলে নিয়ে আবার প্রমাণ করল, ক্রিকেট এখন নিরাপদ, উন্মুক্ত এবং উদযাপনের খেলা পাকিস্তানে।
শাহিন আফ্রিদির নেতৃত্বে পাকিস্তান দলের এই জয় যেন প্রতীক হয়ে থাকল নতুন সূচনার।
ক্রিকেট আবারও ফিরেছে তার আপন ঘরে—ফয়সালাবাদের ইকবাল স্টেডিয়ামে।
MAH – 13627 I Signalbd.com



