বাংলাদেশ ক্রিকেটে আলোচনার ঝড় – কেন হঠাৎ পদত্যাগ করলেন সিনিয়র সহকারী কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন?
বাংলাদেশ ক্রিকেটে একের পর এক পরিবর্তন, বিতর্ক আর নতুন সিদ্ধান্তে এবার যুক্ত হলো আরেকটি আলোচিত নাম—মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। জাতীয় দলের সিনিয়র সহকারী কোচ হিসেবে তাঁর দায়িত্বের মেয়াদ ছিল ২০২৭ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ পর্যন্ত। কিন্তু প্রত্যাশার আগেই এই দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন দেশের অন্যতম অভিজ্ঞ ও প্রভাবশালী এই কোচ।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে (বিসিবি) ইতোমধ্যেই নিজের পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন সালাউদ্দিন। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে আসন্ন দুই টেস্ট ও তিন টি-টোয়েন্টির হোম সিরিজ পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করবেন। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় দলের সঙ্গে তাঁর অধ্যায় শেষ হবে।
“উপভোগ করতে পারছি না, তাই সরে যাচ্ছি” — সালাউদ্দিনের স্বীকারোক্তি
আজ সকালে প্রথম আলো–এর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলার সময় সালাউদ্দিন নিজেই বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন,
“হ্যাঁ, আমি বিসিবিতে আমার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছি। আজ সশরীরে গিয়ে বাকি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করব। তবে আমি আয়ারল্যান্ড সিরিজ পর্যন্ত আছি। পদত্যাগ করলেও নোটিশ পিরিয়ড পর্যন্ত কাজ করে যাব।”
কেন এমন সিদ্ধান্ত, জানতে চাইলে প্রথমে তিনি বলেন, “ব্যক্তিগত কারণ।” কিন্তু কিছুক্ষণ পর যুক্ত করেন,
“কোচিং আমার জীবনের আনন্দের জায়গা। মাঠ আমার সবকিছু। যদি কোনো কারণে সেটা উপভোগ না করতে পারি, তাহলে সরে যাওয়াই ভালো। সত্যি বলতে, আমি আমার দায়িত্বটা আর উপভোগ করছি না।”
তাঁর কণ্ঠে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট ছিল। কিন্তু তিনি বিস্তারিত কারণ জানাতে অনিচ্ছুক থাকেন। শুধু জানান, প্রধান কোচ ফিল সিমন্সের সঙ্গে কাজ করতে কোনো সমস্যা নেই।
বিসিবির অভ্যন্তরে অশান্তি: নাজমূল আবেদীনের সঙ্গে ঠান্ডা সম্পর্ক
বিসিবির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েক মাস ধরে ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান নাজমূল আবেদীনের সঙ্গে সালাউদ্দিনের যোগাযোগ প্রায় বন্ধ। জাতীয় দলের সব বিষয় দেখভাল করে এই বিভাগ, আর সেখানে কোচের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিকভাবেই অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করেছে।
কিছু কর্মকর্তার মতে, কোচিং প্যানেল, খেলোয়াড় বাছাই, ও মাঠের সিদ্ধান্ত নিয়ে একাধিকবার মতবিরোধ তৈরি হয়েছিল দু’জনের মধ্যে। যদিও বিসিবি আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি স্বীকার করেনি।
আশরাফুলকে ব্যাটিং কোচ করা নিয়ে বিতর্ক
এদিকে, সম্প্রতি মোহাম্মদ আশরাফুলকে জাতীয় দলের ব্যাটিং কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের পর থেকেই কোচিং প্যানেলে অস্থিরতা দেখা দেয়।
অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষক মনে করেন,
“বিসিবিতে আগে থেকেই অভিজ্ঞ কোচরা ছিলেন। আশরাফুলকে সরাসরি জাতীয় দলে আনা ঠিক হয়নি। তাঁকে প্রথমে বয়সভিত্তিক বা এইচপি দলে সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল।”
বিসিবির একজন স্থানীয় কোচ বলেন,
“সবকিছুতেই একটা প্রক্রিয়া থাকা উচিত। আশরাফুলের ক্ষেত্রে সেই প্রক্রিয়া মানা হয়নি। এটা ভালো দৃষ্টান্ত নয়।”
তবে এ বিষয়ে সালাউদ্দিন বলেছেন,
“কোচিং স্টাফে আশরাফুলের যোগদানকে আমি স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছি।”
অর্থাৎ তিনি প্রকাশ্যে কোনো অসন্তোষ দেখাননি, যদিও পর্দার আড়ালে সেই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়েছে কোচিং টিমে।
দ্বিগুণ দায়িত্ব, অথচ অভিযোগের ভার
সালাউদ্দিন মূলত সিনিয়র সহকারী কোচ হলেও, ব্যাটিং কোচের দায়িত্বও তাঁকে পালন করতে হয়েছে। ব্যাটিং ব্যর্থতার সময় প্রায়শই সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকেই, যদিও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাটিং কোচ ছিলেন না।
ফারুক আহমেদ বিসিবির সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর সালাউদ্দিনকে নিয়ে প্রশংসা করেছিলেন, এবং তাঁর নেতৃত্বেই সালাউদ্দিন জাতীয় দলে ফেরেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, একাধিক দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে তিনি চাপে পড়ে গেছেন।
ব্যাটিং ব্যর্থতা, উইকেটকিপার নির্বাচন, বা টিম কম্বিনেশন—সব কিছুর দায় এসে পড়েছে তাঁর কাঁধে।
উইকেটকিপার ইস্যুতেও বিতর্ক
সর্বশেষ আফগানিস্তান সিরিজে নুরুল হাসানকে দিয়ে উইকেটকিপিং না করিয়ে জাকের আলীকে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই বিতর্ক তৈরি হয়।
জানা যায়, সালাউদ্দিন চেয়েছিলেন নুরুল হাসানই কিপিং করুক, কিন্তু অধিনায়ক জাকের নিজেই চেয়েছিলেন এই দায়িত্ব নিতে।
সালাউদ্দিন বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তুললেও প্রধান কোচ ফিল সিমন্স হস্তক্ষেপ করেননি। ফলস্বরূপ, সিদ্ধান্তটি থেকে যায় মাঠের অধিনায়কের ওপরেই। অনেকেই মনে করেন, এখান থেকেই শুরু হয় কোচিং ইউনিটের মধ্যে এক ধরণের বিভাজন।
জাতীয় দল থেকে ঘরোয়া ক্রিকেটে ফেরার প্রস্তুতি
জাতীয় দলের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর পর সালাউদ্দিন আবার ফিরতে পারেন ঘরোয়া ক্রিকেটে।
তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, তিনি ইতোমধ্যেই কয়েকটি বিপিএল (বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ) ফ্র্যাঞ্চাইজির সঙ্গে যোগাযোগে আছেন।
বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে সালাউদ্দিনের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা বিশাল। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস, ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স, চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সসহ একাধিক ফ্র্যাঞ্চাইজিতে তিনি সাফল্যের সঙ্গে কোচিং করেছেন। তাই বিপিএলে আবারও তাঁকে দেখা যাবে বলেই আশা করছেন ভক্তরা।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে সালাউদ্দিনের ভূমিকা ও উত্তরাধিকার
মোহাম্মদ সালাউদ্দিন শুধু একজন কোচ নন, তিনি অনেক খেলোয়াড়ের ‘মেন্টর’।
সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, নাসির হোসেন—বাংলাদেশের বহু তারকা ক্রিকেটার তাঁর হাতে গড়া।
তাঁর তৈরি করা খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাস, মানসিক দৃঢ়তা এবং কৌশলগত দৃষ্টি বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
তাঁর অনুপস্থিতি নিঃসন্দেহে একটি শূন্যতা তৈরি করবে জাতীয় দলের কোচিং ইউনিটে।
বিসিবির অবস্থান কী?
বিসিবি সূত্র জানায়, সালাউদ্দিনের পদত্যাগপত্র পাওয়া গেছে।
বোর্ড আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি পর্যালোচনা করছে।
একজন কর্মকর্তা বলেন,
“তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ কোচ। তাঁর অবদান আমরা অস্বীকার করি না। তবে কোচিং স্টাফে অনেক পরিবর্তন আসছে। নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি।”
এতে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, বোর্ড হয়তো নতুন কোচিং কাঠামো তৈরি করতে চাইছে—যেখানে ফিল সিমন্সের অধীনে একাধিক বিদেশি সহকারী কোচ যুক্ত হতে পারেন।
সালাউদ্দিনের সিদ্ধান্তের পেছনে ‘অদৃশ্য চাপ’?
অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিসিবির কিছু সিদ্ধান্তে সালাউদ্দিনের মতামত উপেক্ষা করা হচ্ছিল। খেলোয়াড় নির্বাচনে প্রভাব, কোচিং প্যানেলে নতুন মুখ যুক্ত করা, ও সিনিয়র খেলোয়াড়দের ভূমিকা নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল, তাতে তিনি ধীরে ধীরে হতাশ হয়ে পড়েন।
তাঁর ঘনিষ্ঠ এক সহকর্মী বলেন,
“সালাউদ্দিন মাঠের মানুষ। তিনি সিদ্ধান্ত নিতে চান ক্রিকেটীয় যুক্তিতে। কিন্তু যখন প্রশাসনিক সিদ্ধান্তগুলো মাঠের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন তাঁর পক্ষে কাজ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।”
ভক্তদের প্রতিক্রিয়া
সামাজিক মাধ্যমে সালাউদ্দিনের পদত্যাগের খবরে ভক্তদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
অনেকে বলেছেন,
“সালাউদ্দিনের মতো অভিজ্ঞ কোচকে হারানো মানে একটা যুগের সমাপ্তি।”
আবার কেউ কেউ মনে করেন,
“নতুন কোচিং দলকে সময় দেওয়া উচিত। পরিবর্তনই উন্নতির অংশ।”
তবে অধিকাংশ ক্রিকেটপ্রেমীই একমত—সালাউদ্দিন বাংলাদেশের ক্রিকেটে এক অমূল্য সম্পদ, এবং তাঁর অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতেও দেশের ক্রিকেটে কাজে লাগানো উচিত।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে পরিবর্তন নতুন কিছু নয়। তবে মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের বিদায় একটি বড় বার্তা বহন করছে—
মাঠের সাফল্যের জন্য কেবল খেলোয়াড় নয়, কোচিং পরিবেশ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোর্ডের পেশাদার দৃষ্টিভঙ্গিও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
যদি এসব জায়গায় উন্নতি না আসে, তবে যতই প্রতিভাবান কোচ আসুক, বাংলাদেশের ক্রিকেটে স্থিতিশীলতা আসবে না।
সালাউদ্দিন বলেছেন,
“আমি মাঠ ছাড়ছি না, আমি শুধু দিক পরিবর্তন করছি।”
তাঁর এই বার্তা হয়তো বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্যও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
MAH – 13626 I Signalbd.com



