
মিরপুরে রিশাদের ঝড়ে ঘুরে দাঁড়ালো বাংলাদেশ
মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের ব্যাটিং যেন থমকে গিয়েছিল। একের পর এক উইকেট হারিয়ে যখন দুইশ রানের নাগালও কঠিন মনে হচ্ছিল, তখন ৯ নম্বরে নেমে রীতিমতো ঝড় তোলেন তরুণ অলরাউন্ডার রিশাদ হোসেন। মাত্র ১৪ বলে ৩৯ রানের বিস্ফোরক ইনিংসে ভর করে ৫০ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে ২১৩ রানের লড়াকু সংগ্রহ দাঁড় করায় বাংলাদেশ।
প্রথম ম্যাচের আত্মবিশ্বাস নিয়ে দ্বিতীয় ওয়ানডে
প্রথম ওয়ানডেতে টস হেরে ব্যাট করে অল্প রান করেও দারুণভাবে জিতেছিল বাংলাদেশ। সেই আত্মবিশ্বাস নিয়েই দ্বিতীয় ম্যাচে মাঠে নামে মেহেদি হাসান মিরাজের দল। এবার টস জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন অধিনায়ক।
তবে ব্যাটিং-বান্ধব নয়, বরং স্পিন সহায়ক মিরপুরের উইকেটে রান তুলতে হয়েছে কঠিন পরিশ্রমে। শুরু থেকেই ক্যারিবীয় স্পিনারদের ঘূর্ণিতে ভুগেছেন টাইগার ব্যাটাররা।
সতর্ক সূচনা, কিন্তু দ্রুত পতন
ইনিংসের সূচনায় ব্যাট হাতে নামেন সৌম্য সরকার ও সাইফ হাসান। দুজনই বেশ সতর্কভাবে শুরু করলেও, স্কোরবোর্ডে ২০ রান উঠতেই ভাঙে জুটি। সাইফ হাসান ১৬ বল খেলে ৬ রান করে স্লিপে ক্যাচ দেন—প্রথম ম্যাচের মতো এখানেও ব্যর্থ তিনি।
এরপর এক নম্বর ডাউন পজিশনে উঠে আসেন তাওহিদ হৃদয়। তাকে ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন দিয়ে পাঠানো হয় দলের রানের গতি বাড়ানোর আশায়। কিন্তু সেই আশায় জল ঢেলে ১৯ বলে ১২ রান করেই বিদায় নেন হৃদয়।
শান্ত ও অঙ্কনের ব্যর্থতা
বাংলাদেশের ইনিংসের মাঝখানে বড় ভূমিকা রাখার প্রত্যাশা ছিল নাজমুল হোসেন শান্ত ও অঙ্কন বিশ্বাসের ওপর। কিন্তু দুজনই ব্যর্থ। শান্ত ২১ বলে ১৫ রান করে ক্যাচ তুলে ফেরেন। অঙ্কন কিছুটা সময় কাটিয়ে ৩৫ বলে ১৭ রান করেন, কিন্তু বড় ইনিংস খেলতে পারেননি।
এক প্রান্তে সৌম্য তখনো অবিচল। সাবধানী শুরু থেকে ধীরে ধীরে গতি বাড়িয়ে ফিফটির পথে এগোচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ৪৫ রানে এসে হঠাৎ আক্রমণাত্মক শট খেলতে গিয়ে বাউন্ডারিতে ধরা পড়েন। ৮৯ বলে ৪৫ রানের ইনিংসটি দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও, তিনি সেটিকে বড় রূপ দিতে পারেননি।
নাসুম-মিরাজের ছোট কিন্তু কার্যকর জুটি
৫ উইকেটে ১০৩ রানের পর পরিস্থিতি ছিল বেশ বিপদজনক। তখন সাতে নেমে আসেন নাসুম আহমেদ। তাকে পাঠানোর সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্টের কৌশলগত পদক্ষেপ ছিল।
নাসুম এক ছক্কায় ১৪ রান করেন—যা ইনিংসের গতি কিছুটা ফিরিয়ে আনে। অন্যদিকে অধিনায়ক মেহেদি হাসান মিরাজ ঠাণ্ডা মাথায় ইনিংস গড়তে থাকেন। তার ব্যাট থেকে আসে ধৈর্যশীল ও মূল্যবান ৫৮ বলে ৩২ রান।
সোহানের ছোট ইনিংস, বড় অবদান
শেষদিকে রানের চাপ সামলাতে নামেন নুরুল হাসান সোহান। দ্রুত রান তুলতে গিয়ে ২৪ বলে ২৩ রানে আউট হন। কিন্তু তার সেই ছোট ইনিংস দলকে কিছুটা এগিয়ে দেয়।
৪৬তম ওভারে যখন সোহান ফিরলেন, তখন দলের সংগ্রহ মাত্র ১৬৩ রান। সেখান থেকে দুইশ রানের লক্ষ্য তখন অনেক দূরে—কিন্তু ভাগ্য তখনও রিশাদের হাতে লেখা ছিল।
রিশাদের ঝড় – ম্যাচের রঙ পাল্টানো ইনিংস
ইনিংসের ৪৭তম ওভারে নামেন রিশাদ হোসেন। আগের ম্যাচেও বল হাতে ছিলেন কার্যকর, এবার ব্যাটে দেখালেন তার প্রতিভার ঝলক। মাত্র ১৪ বলে ৩৯ রানের ঝোড়ো ইনিংস খেলেন তিনি, যাতে ছিল ৪টি ছক্কা ও ২টি চারের মার।
মিরাজের সঙ্গে তার ৫০ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি দলকে ২০০ রানের গণ্ডি পেরিয়ে ২১৩ রানের লড়াকু সংগ্রহে পৌঁছে দেয়। শেষ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলাররা ছিল সম্পূর্ণ অসহায়।
বাংলাদেশের ইনিংস সারসংক্ষেপ:
ব্যাটসম্যান | রান | বল | ছক্কা | চার |
---|---|---|---|---|
সৌম্য সরকার | ৪৫ | ৮৯ | ১ | ৩ |
সাইফ হাসান | ৬ | ১৬ | ১ | ০ |
তাওহিদ হৃদয় | ১২ | ১৯ | ০ | ১ |
শান্ত | ১৫ | ২১ | ০ | ১ |
অঙ্কন বিশ্বাস | ১৭ | ৩৫ | ০ | ২ |
নাসুম আহমেদ | ১৪ | ১৮ | ১ | ০ |
মিরাজ (অপরাজিত) | ৩২ | ৫৮ | ০ | ২ |
সোহান | ২৩ | ২৪ | ০ | ২ |
রিশাদ (অপরাজিত) | ৩৯ | ১৪ | ৪ | ২ |
স্পিন সহায়ক উইকেট, বোলারদের চ্যালেঞ্জ
মিরপুরের উইকেটের চরিত্র আজও অনেকটাই ধীর ছিল। বল থেমে আসছিল, টার্ন করছিল প্রচুর। ওয়েস্ট ইন্ডিজের অফস্পিনার অ্যাথানেজ ও বামহাতি স্পিনার গুডাকেশ মটেন বারবার ব্যাটসম্যানদের পরীক্ষা নিয়েছেন।
তবে বাংলাদেশও জানে, এই উইকেটে তাদের স্পিন আক্রমণ ভয়ংকর হতে পারে। প্রথম ম্যাচে যেভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, সেরকমই কিছু দেখতে পারে দর্শকরা এই ম্যাচেও।
রিশাদ হোসেন: বাংলাদেশের ভবিষ্যতের উজ্জ্বল তারা
মাত্র ২২ বছর বয়সী রিশাদ এখন বাংলাদেশের ওয়ানডে দলে নতুন প্রাণ। মূলত লেগ স্পিনার হিসেবে পরিচিত এই তরুণ ব্যাট হাতেও নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিচ্ছেন একের পর এক ম্যাচে।
তার ইনিংস শুধু রান বাড়ায়নি, দলের মনোবলও দ্বিগুণ করেছে। ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মতে, “রিশাদ এখন বাংলাদেশের ওয়ানডে দলের ‘এক্স-ফ্যাক্টর’। সে খেলায় এলে সবসময় কিছু না কিছু ঘটে।”
মিরাজের নেতৃত্বে আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশ
এই সিরিজে নিয়মিত অধিনায়ক না থাকায় দায়িত্ব পেয়েছেন মেহেদি হাসান মিরাজ। বল ও ব্যাট—দুই ক্ষেত্রেই তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন। দলের প্রতি তার ঠাণ্ডা মাথার সিদ্ধান্ত ও মাঠে উপস্থিত বুদ্ধি প্রশংসিত হয়েছে ক্রিকেট মহলে।
দ্বিতীয় ম্যাচেও মিরাজের ৩২ রানের ইনিংস ও রিশাদকে সঠিক সময়ে ব্যাটিংয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্ত ছিল ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট।
প্রথম ওয়ানডের ছাপ: আত্মবিশ্বাসের জায়গা
প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়েও জিতেছিল বোলারদের নৈপুণ্যে। তাই আজও দলের আত্মবিশ্বাস ছিল আকাশচুম্বী। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এই সিরিজে বাংলাদেশের লক্ষ্য—সিরিজ জয় নিশ্চিত করা।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং সারাংশ
ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে সবচেয়ে সফল বোলার ছিলেন গুডাকেশ মটেন, যিনি ১০ ওভারে ৩৯ রান দিয়ে নিয়েছেন ২ উইকেট। এছাড়া জোসেফ ও হোল্ডার প্রত্যেকে ১টি করে উইকেট নেন।
তবে শেষদিকে রিশাদের তাণ্ডব সামলাতে পারেননি কেউই। শেষ ৫ ওভারে বাংলাদেশ তুলে নেয় ৫০-এর বেশি রান—যা ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।
দ্বিতীয় ইনিংসে চোখ থাকবে স্পিনারদের দিকে
বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হওয়ার পরই বোঝা যাচ্ছিল, এই উইকেটে ২১৩ রানের লক্ষ্য মোটেও সহজ নয়। টাইগারদের চার স্পিনার—মিরাজ, রিশাদ, নাসুম ও শান্ত—এই উইকেটে ভয়ংকর হতে পারেন।
অন্যদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজকেও সিরিজে টিকে থাকতে হলে এই লক্ষ্য তাড়া করে জিততেই হবে। ফলে দ্বিতীয় ইনিংসটি হবে আসল পরীক্ষা।
বিশ্লেষণ: ব্যাটিংয়ে ঘাটতি, কিন্তু লড়াইয়ের মনোভাব অটুট
বাংলাদেশ দলের টপ অর্ডার এখনও চিন্তার জায়গা। সাইফ, হৃদয় ও শান্ত ধারাবাহিক হতে পারছেন না। তবে মধ্য ও নিচের সারিতে রিশাদ-মিরাজের দৃঢ়তা দলকে আশার আলো দেখাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “বাংলাদেশ এখন আর একতরফা দল নয়। নিচের ব্যাটাররাও ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারে।”
রিশাদের এই ইনিংস শুধু ২১৩ রানের সংগ্রহ এনে দেয়নি—এটি টাইগারদের আত্মবিশ্বাস, তেজ ও দলগত স্পিরিটের প্রতীক হয়ে থাকবে। ম্যাচের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা, স্পিন সহায়ক উইকেটে কে জয় তুলে নেয়—বাংলাদেশ না ওয়েস্ট ইন্ডিজ?
MAH – 13412 I Signalbd.com