ব্রাজিলের ডাগআউটে আনচেলত্তি, বেতন মাসে ১০ কোটি টাকারও বেশি

সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা হলো—ইতালিয়ান ফুটবল কিংবদন্তি কার্লো আনচেলত্তি হচ্ছেন ব্রাজিল জাতীয় ফুটবল দলের নতুন কোচ। পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের কোচ হিসেবে আনচেলত্তি দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন ২৬ মে থেকে, যা ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ছয় দশক পর প্রথমবারের মতো ব্রাজিলের ডাগআউটে বসতে যাচ্ছেন একজন বিদেশি কোচ।
ষাট বছরের পরিক্রমায় প্রথম বিদেশি কোচ
ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন (CBF) দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বকাপ পুনর্জয়ের লক্ষ্যে নতুন পরিকল্পনার খোঁজে ছিল। দেশটির ফুটবলে বিদেশি কোচের আগমন সব সময়ই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, তবে আনচেলত্তির মতো একজন সফল ও অভিজ্ঞ কোচকে নিয়োগের বিষয়টি ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের ভিন্নধর্মী পদক্ষেপ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। সর্বশেষ ১৯৬৫ সালে ব্রাজিলের জাতীয় দলের কোচ ছিলেন এক বিদেশি; এরপর এতদিন ধরে শুধুই ব্রাজিলিয়ান কোচদের ওপর আস্থা রেখেছে ফেডারেশন।
আনচেলত্তির বেতন: ইতিহাসের সর্বোচ্চ
আন্তর্জাতিক ক্রীড়া গণমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, কার্লো আনচেলত্তির মাসিক বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। বার্ষিক হিসাবে তা দাঁড়ায় প্রায় ১২১ কোটি ২০ লাখ টাকার সমপরিমাণ। এই বেতন তাকে ব্রাজিল জাতীয় দলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত কোচের মর্যাদা দিয়েছে।
সাবেক কোচ তিতে এবং দোরিভাল জুনিয়রের তুলনায় আনচেলত্তির এই বেতন প্রায় দ্বিগুণ। ইএসপিএনের তথ্য অনুসারে, এই বেতন কাঠামো ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের জন্য এক নজিরবিহীন বিনিয়োগ, যা দলের শিরোপা প্রত্যাশাকে প্রতিফলিত করে।
বিশাল বোনাস ও বিশেষ সুবিধাসমূহ
বেতন ছাড়াও থাকছে আকর্ষণীয় বোনাস ও সুযোগ-সুবিধার প্যাকেজ। যদি আনচেলত্তি ২০২৬ সালের বিশ্বকাপ শিরোপা ব্রাজিলের হাতে তুলে দিতে পারেন, তাহলে অতিরিক্ত ৫ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৬০ কোটি টাকারও বেশি) বোনাস পাবেন তিনি।
এছাড়া ব্যক্তিগত জীবনের জন্যও তার জন্য রাখা হয়েছে বিলাসবহুল আয়োজন—রিও ডি জেনেইরোতে একটি আধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট, আন্তর্জাতিক মানের স্বাস্থ্য ও জীবনবিমা সুবিধা, এবং বিশেষ প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য ব্যক্তিগত জেট। এসব সুবিধা সরাসরি অর্থায়ন করছে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন, যা কোচের মনোযোগ যেন শুধুই মাঠের খেলায় থাকে, সে উদ্দেশ্যে।
আনচেলত্তির রেকর্ড: বিশ্ব ফুটবলের গর্ব
কার্লো আনচেলত্তির কোচিং ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ, সাফল্যে পূর্ণ ও অনন্য। ইউরোপের পাঁচটি শীর্ষ লিগ—ইতালিয়ান সিরি আ, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, ফরাসি লিগ আঁ, জার্মান বুন্দেসলিগা এবং স্প্যানিশ লা লিগা—সব কটিতেই চ্যাম্পিয়ন হওয়া একমাত্র কোচ তিনি। মিলান, চেলসি, রিয়াল মাদ্রিদ, পিএসজি এবং বায়ার্ন মিউনিখের মতো ক্লাবে তিনি কাজ করেছেন এবং প্রতিটি ক্লাবে সফলতার ছাপ রেখেছেন।
চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ চারবার ট্রফি জয়ের কীর্তিও আছে তার। এসব অর্জনই বোঝায়, কেন তাকে ব্রাজিল জাতীয় দলের জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
আনচেলত্তির মিশন শুরু: বিশ্বকাপ বাছাই
আগামী জুনেই আনচেলত্তির কোচিং অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে। ২০২৬ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ব্রাজিলের প্রথম দুই প্রতিপক্ষ হলো ইকুয়েডর এবং প্যারাগুয়ে। এই দুটি ম্যাচ দিয়ে আনচেলত্তি বুঝে নেবেন তার নতুন দলকে, এবং চেষ্টা করবেন ইউরোপীয় কৌশলের সঙ্গে ব্রাজিলের ঐতিহ্যবাহী ‘জোগো বনিতো’—শৈল্পিক ফুটবলের সমন্বয় ঘটাতে।
তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। ব্রাজিল বর্তমানে প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের ঘাটতিতে নেই, তবে সাম্প্রতিক টুর্নামেন্টগুলোতে দলের ধারাবাহিকতা ও মানসিক দৃঢ়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আনচেলত্তিকে শুধু কৌশলগত দিক নয়, মানসিক দিক থেকেও খেলোয়াড়দের প্রস্তুত করতে হবে।
ব্রাজিলিয়ান মিডিয়া ও সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া
আনচেলত্তির আগমনকে কেন্দ্র করে ব্রাজিলজুড়ে আলোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ মনে করছেন, বিদেশি কোচ আনার মাধ্যমে ব্রাজিল ফুটবল তার নিজের পরিচয় থেকে সরে আসছে। আবার অনেকে বলছেন, সময়ের দাবি মেটাতে এমন একজন অভিজ্ঞ ও সাফল্যপ্রাপ্ত কোচকে আনাই ছিল বাস্তব সিদ্ধান্ত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আনচেলত্তি যদি তার ইউরোপীয় অভিজ্ঞতাকে ব্রাজিলের প্রতিভার সঙ্গে সমন্বয় করতে পারেন, তবে আগামী বিশ্বকাপ ব্রাজিলের জন্য হতে পারে ষষ্ঠ শিরোপা জয়ের সুবর্ণ সুযোগ।
ভবিষ্যতের রূপরেখা
কার্লো আনচেলত্তির ব্রাজিল অধ্যায় কেবলমাত্র একটি নিয়োগের খবর নয়—এটি ভবিষ্যতের দিকে একটি সাহসী পদক্ষেপ। বিশ্বের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ফুটবল দলের কোচ হিসেবে তার দায়িত্ব শুধু একটি দলের নয়, বরং একটি জাতির আশা ও স্বপ্ন বহনেরও।
বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চে ব্রাজিল নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। আনচেলত্তির অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা ও কৌশলগত গভীরতা যদি ব্রাজিলের তরুণ তারকাদের সঙ্গে সঠিকভাবে কাজ করে, তবে ২০২৬ সালের বিশ্বকাপে আমরা হয়তো দেখতে পাব এক নতুন ও দুর্দান্ত ব্রাজিল, যেখানে মিশে থাকবে ইউরোপের শৃঙ্খলা আর লাতিন আমেরিকার আবেগ।