ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (ডিজি) সঙ্গে অসদাচরণ ও তর্কে জড়ানোর অভিযোগে হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি ইনচার্জ ডা. ধনদেব বর্মণকে বরখাস্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাঁকে শুধু দায়িত্ব থেকে অব্যাহতিই দেওয়া হয়নি, একইসঙ্গে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়েছে। শনিবার (৬ ডিসেম্বর) রাতে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল গোলাম ফেরদৌস স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এই আদেশ দেওয়া হয়। এই ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। কর্তৃপক্ষ বলছে, ডা. ধনদেব বর্মণ সরকারি বিধি ভঙ্গ করেছেন, যার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে এই কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ডিজি’র পরিদর্শন ও তর্কের সূত্রপাত
ঘটনাটি ঘটে শনিবার (৬ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেবা বিভাগের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শনে আসেন। তিনি মূলত শিশুদের মূত্রাশয় ও প্রজননতন্ত্র সম্পর্কিত রোগের চিকিৎসাবিষয়ক চলমান চিকিৎসার অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে একটি সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিতে এসেছিলেন।
সেমিনারে অংশগ্রহণের পূর্বে অধ্যাপক ডা. আবু জাফর হাসপাতাল পরিদর্শনকালে সেবার মান, জরুরি বিভাগ পরিচালনা, রোগী ব্যবস্থাপনা ও স্টাফদের উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ সময় হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি ইনচার্জ এবং ক্যাজুয়ালটি অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) কর্মরত ডা. ধনদেব বর্মণ তাঁর বিভাগের সীমাবদ্ধতা, জনবল সংকট এবং দায়িত্ব পালনের চাপ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এই নিয়ে ডিজি ও ডা. ধনদেব বর্মণের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় ও তর্কের সৃষ্টি হয়।
সরকারি বিধি লঙ্ঘন ও বরখাস্তের নির্দেশ
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দ্রুত এই ঘটনায় প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়েছে। হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মোহাম্মদ মাঈন উদ্দিন খান নিশ্চিত করে জানান, হাসপাতাল পরিদর্শনকালে স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফরের সঙ্গে হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি ওটির ইনচার্জ ডা. ধনদেব বর্মণ সরকারি বিধি ভঙ্গ করে অসদাচরণ করেন এবং তর্কে জড়িয়েছেন।
ডা. মাঈন উদ্দিন খান বলেন, ‘যা মোটেও কাম্য নয়।’ এই অসদাচরণের কারণে ডিজি অধ্যাপক ডা. আবু জাফরের নির্দেশে ডা. ধনদেব বর্মণকে তাঁর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। হাসপাতাল পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল গোলাম ফেরদৌস স্বাক্ষরিত চিঠিতে তাঁকে শোকজ নোটিশ দেওয়ার পাশাপাশি বরখাস্তের নির্দেশ দেওয়া হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ভাইরাল
মহাপরিচালক এবং চিকিৎসকের মধ্যেকার এই উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের ঘটনায় সে সময় সেখানে উপস্থিত কেউ একজন ভিডিও ধারণ করেন। এই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
ভিডিওতে ডা. ধনদেব বর্মণকে তাঁর বিভাগের জনবল সংকট ও কাজের চাপ নিয়ে উচ্চ কণ্ঠে কথা বলতে দেখা যায়। এই ভিডিওটি নিয়ে সাধারণ মানুষ এবং অন্যান্য চিকিৎসক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ কেউ স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা তুলে ধরার জন্য ডা. ধনদেব বর্মণকে সমর্থন করলেও, অধিকাংশ মানুষ একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর আচরণের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
কারণ দর্শানোর নোটিশ ও পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া
ডা. ধনদেব বর্মণকে শুধু দায়িত্ব থেকে অব্যাহতিই দেওয়া হয়নি, তাঁকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কারণ দর্শাতে (Show Cause) বলা হয়েছে। তাঁকে লিখিতভাবে জানাতে হবে কেন তিনি একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে এমন অসদাচরণ করেছেন।
সহকারী পরিচালক ডা. মাইনুদ্দিন জানান, নোটিশের জবাব পাওয়ার পরে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারি কর্মচারী হিসেবে অসদাচরণ এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি চাকরি আইন, আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। এই ঘটনা অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটি কড়া সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করবে।
জনবল সংকট ও অব্যবস্থাপনার প্রশ্ন
যদিও ডা. ধনদেব বর্মণের অসদাচরণ সরকারি বিধি লঙ্ঘনের শামিল, তবুও তাঁর উত্থাপিত জনবল সংকট এবং হাসপাতাল পরিচালনার সীমাবদ্ধতার প্রশ্নটি জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল একটি বৃহৎ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী আসে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ক্যাজুয়ালটি বিভাগসহ হাসপাতালের বিভিন্ন অংশে জনবল সংকট এবং অতিরিক্ত কাজের চাপ রয়েছে। এই অব্যবস্থাপনা এবং কাঠামোগত সীমাবদ্ধতাগুলোই সম্ভবত ডা. ধনদেব বর্মণের ক্ষোভের কারণ ছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কেবল অসদাচরণের জন্য শাস্তি নয়, বরং চিকিৎসকের অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে হাসপাতালের সেবার মান উন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়াও জরুরি।
প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও সেবার মান
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে তর্কে জড়ানো চিকিৎসকের বরখাস্ত হওয়ার ঘটনাটি সরকারি প্রশাসনে শৃঙ্খলা ও দায়িত্বশীলতার গুরুত্বকে তুলে ধরে। ডা. ধনদেব বর্মণকে শোকজ এবং দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় এই ধরনের প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থান নিল। তবে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ময়মনসিংহ হাসপাতালের সেবার মান ও জনবল সংকট নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তা সমাধানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে মনোযোগ দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো চিকিৎসককে ক্ষোভ থেকে এমন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে না হয়।
এম আর এম – ২৫১৫, Signalbd.com



