রাজশাহীতে এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আবদুর রহমানের ভাড়া বাসায় ঢুকে তাঁর ছেলে তাওসিফ রহমান সুমনকে (১৫) ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন বিচারকের স্ত্রী তাসমিন নাহার। তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে সন্দেহভাজন এক ব্যক্তিকে আটক করেছে। তার নাম ইমন (৩২), বাড়ি গাইবান্ধায়।
ঘটনার বিস্তারিত
পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টার দিকে রাজশাহী নগরের ডাবতলা এলাকায় বিচারক আবদুর রহমানের ভাড়া বাসায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। পরিবারটি ওই বাড়িতে বেশ কিছুদিন ধরে ভাড়া থাকছিলেন। ঘটনার সময় বিচারক আবদুর রহমান কর্মস্থলে ছিলেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিকেলের দিকে এক ব্যক্তি ওই বাসায় প্রবেশ করে। কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে যান। তখন দেখা যায়, বাড়ির ভেতরে তাওসিফ রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে এবং তাঁর মা তাসমিন নাহার গুরুতর আহত। স্থানীয়রা দ্রুত দুজনকেই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান, যেখানে চিকিৎসক তাওসিফকে মৃত ঘোষণা করেন।
পুলিশের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা
ঘটনার খবর পেয়ে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের একাধিক ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। দ্রুত অভিযান চালিয়ে তারা সন্দেহভাজন হামলাকারী ইমনকে আটক করে। আটক অবস্থায় তিনিও আহত ছিলেন, বর্তমানে তিনি হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) গাজিউর রহমান বলেন, “ঘাতককে আটক করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, সে পূর্বপরিচিত। ঘটনার কারণ ও উদ্দেশ্য উদঘাটনে তদন্ত চলছে।”
আহত তাসমিন নাহারের অবস্থা
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মুখপাত্র শংকর কুমার বিশ্বাস বলেন, “তাসমিন নাহারকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর শরীরে একাধিক স্থানে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। জরুরি বিভাগে অস্ত্রোপচার চলছে।”
হাসপাতাল সূত্রে আরও জানা গেছে, ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে তাসমিন নাহার হামলাকারীর কবলে পড়েন। তাঁকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
হামলাকারীর পরিচয় ও পূর্বের সম্পর্ক
পুলিশ জানায়, আটক ইমন নামের ব্যক্তির সঙ্গে বিচারক আবদুর রহমানের পূর্বপরিচয় ছিল। তিনি বিচারক আবদুর রহমান সিলেটে কর্মরত থাকাকালে তাঁর বিরুদ্ধেই একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন। ইমন দীর্ঘদিন ধরে মানসিক সমস্যায় ভুগছিল বলে জানা গেছে।
একজন তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, পূর্বের কোনো মানসিক ক্ষোভ বা প্রতিশোধের কারণে এই হামলা হয়েছে। তবে এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত করা হচ্ছে।”
প্রতিবেশীদের বর্ণনা
ঘটনার সময় আশপাশের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, “আমরা বিকেলে চিৎকার শুনে দৌড়ে যাই। দেখি রক্তে ভেজা অবস্থায় ছেলে মেঝেতে পড়ে আছে। তাঁর মা কাঁদছিলেন। এটা খুবই ভয়ঙ্কর দৃশ্য ছিল।”
আরেক প্রতিবেশী বলেন, “হামলাকারী সম্ভবত পরিবারের পরিচিত কেউ ছিল। না হলে সে এত সহজে ঘরে ঢুকতে পারত না।”
বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
ঘটনার পর রাজশাহী বিভাগীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা হাসপাতালে ছুটে যান। রাজশাহী জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সহকর্মীরা নিহতের পরিবারের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার বিষয়ে দ্রুত তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিচারকদের নিরাপত্তা জোরদারের বিষয়েও আলোচনা চলছে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে এবং ওই বাড়িটি ঘিরে রেখেছে ফরেনসিক দল। হত্যাকাণ্ডের স্থান থেকে একটি ধারালো ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের ক্রাইম সিন ইউনিট ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করছে।
উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) বলেন, “এই হত্যাকাণ্ডটি অত্যন্ত সংবেদনশীল। ফরেনসিক রিপোর্ট ও জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে বিস্তারিত জানা যাবে। ইতিমধ্যে হামলাকারীর মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য জিনিস জব্দ করা হয়েছে।”
প্রেক্ষাপট ও উদ্বেগ
বিচারক পরিবারের ওপর এমন নৃশংস হামলার ঘটনা দেশে বিরল। আইনি মহলে এই ঘটনাকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি বিচারক ও তাঁদের পরিবারের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নতুন করে চিন্তার কারণ তৈরি করেছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন, “বিচার বিভাগের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যদি পূর্বে অভিযুক্ত ব্যক্তিই এমন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে এটি একটি বড় প্রশাসনিক ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হবে।”
রাজশাহীতে বিচারক আবদুর রহমানের পরিবারের ওপর হামলায় নিহত হয়েছেন তাঁর একমাত্র ছেলে তাওসিফ রহমান সুমন, আর গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তাঁর স্ত্রী তাসমিন নাহার। পুলিশের তৎপরতায় হামলাকারী আটক হয়েছে, তবে ঘটনার রহস্য উদঘাটন এখনো বাকি। প্রশাসন বলছে, ঘটনার পেছনে যেই থাকুক না কেন, দায়ীদের আইনের আওতায় আনা হবে।
এম আর এম – ২২২০,Signalbd.com



