টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলায় গভীর রাতে ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ড থেকে প্রাণে বেঁচে গেলেন যাত্রীবাহী বাসের প্রায় চল্লিশজন যাত্রী। বুধবার দিবাগত রাত একটার দিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বাঐখোলা এলাকায় ‘স্টার বাংলা’ পরিবহনের একটি বাসে হঠাৎ করেই আগুন ধরে যায়। মুহূর্তেই বাসটি দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। তবে যাত্রীদের দ্রুত সাড়া ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় প্রাণহানি ছাড়াই ভয়াবহ দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়।
ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাতে উত্তরবঙ্গমুখী লেনে একাধিক যানবাহন ধীরগতিতে চলছিল। এর আগে রাত ১১টার দিকে মহাসড়কের একই এলাকায় একটি ট্রাক দুর্ঘটনার কারণে যানজট সৃষ্টি হয়। সে কারণেই বাসগুলো খুব ধীরে অতিক্রম করছিল।
ঢাকা থেকে পাবনাগামী যাত্রীবাহী ‘স্টার বাংলা’ বাসটি রাত একটার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছালে পেছনের দিক থেকে হঠাৎ বিকট শব্দ হয়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বাসের পেছনের অংশে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যায়। আতঙ্কিত হয়ে যাত্রীরা চিৎকার শুরু করেন। চালক ও সহকারী দ্রুত বাসটি রাস্তার পাশে থামান এবং সবাইকে নামতে বলেন। মাত্র এক-দুই মিনিটের মধ্যে বাসটি আগুনে পুরোপুরি পুড়ে যেতে শুরু করে।
একজন যাত্রী, মো. রাসেল হোসেন (৩৮), যিনি তখন জানালার পাশে বসেছিলেন, বলেন—
“হঠাৎ একটা শব্দ হলো, তারপর দেখি ধোঁয়া আর আগুন। আমরা সবাই চিৎকার করতে করতে নিচে নেমে আসি। কয়েকজনের ব্যাগ আর জিনিসপত্র পুড়ে গেছে, কিন্তু আল্লাহর রহমতে কেউ আহত হয়নি।”
দ্রুত উদ্ধার অভিযান ও ফায়ার সার্ভিসের ভূমিকা
খবর পেয়ে টাঙ্গাইল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের দুটি ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। প্রায় আধঘণ্টার চেষ্টায় তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন।
ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার এস. এম. হুমায়ূন কর্ণায়েন বলেন—
“ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দুটি ইউনিট রওনা দেয়। সৌভাগ্যক্রমে যাত্রীরা সবাই সময়মতো বাস থেকে বের হয়ে যেতে পেরেছেন। তবে বাসটি সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে বাসের ইঞ্জিনের পেছনের অংশে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বা জ্বালানি লাইনে লিকেজ থেকেই আগুনের সূত্রপাত ঘটে থাকতে পারে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
দুর্ঘটনাস্থলে যান চলাচল বন্ধ, ভোগান্তিতে শত শত যাত্রী
অগ্নিকাণ্ডের কারণে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের উত্তরমুখী লেনে প্রায় এক ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকে। ফলে মহাসড়কের দুই পাশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে টাঙ্গাইল, এলেঙ্গা ও মির্জাপুর পর্যন্ত গাড়ির সারি লেগে যায়। পুলিশ ও হাইওয়ে পেট্রোল দল দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং অগ্নিনির্বাপণ শেষে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
বাসাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নুরুল ইসলাম বলেন—
“আমরা ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সমন্বয় করে দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি। এ ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও বাসটি সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। তদন্ত চলছে।”
প্রাথমিক তদন্ত: কেন ঘটল এই আগুন?
প্রাথমিক তদন্তে দেখা যাচ্ছে, বাসটির পেছনের দিকের ইঞ্জিন কুলিং সিস্টেমে সমস্যা ছিল। এছাড়া পুরোনো তারের সংযোগ থেকে স্পার্ক হয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে। অনেক সময় অতিরিক্ত তাপমাত্রায় ডিজেল বা পেট্রোল লিক হলে সামান্য স্ফুলিঙ্গও ভয়াবহ আগুনের কারণ হতে পারে।
বাসচালক আব্দুল মালেক বলেন—
“আমি হঠাৎ পেছনে ধোঁয়া দেখতে পাই। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামাই। যাত্রীদের নামিয়ে দেই। এর পরপরই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। যদি আরও কয়েক সেকেন্ড দেরি হতো, বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত।”
যাত্রীদের আতঙ্ক ও ক্ষয়ক্ষতি
যাত্রীদের বেশিরভাগই কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরছিলেন বা উৎসবের ছুটিতে উত্তরাঞ্চলের পথে ছিলেন। অনেকের ব্যাগ, মোবাইল ফোন, ও ব্যক্তিগত কাগজপত্র আগুনে পুড়ে গেছে।
টাঙ্গাইলের স্থানীয় বাসিন্দা হাফিজুল ইসলাম জানান—
“আমরা দূর থেকে আগুনের শিখা দেখতে পাই। সঙ্গে সঙ্গে লোকজন নিয়ে ছুটে যাই। যাত্রীরা সবাই চিৎকার করছিলেন। স্থানীয়রা সবাই মিলে উদ্ধার কাজে সহায়তা করি।”
সড়কে আগুনের এমন ঘটনা নতুন নয়
বাংলাদেশে চলন্ত বাসে আগুন লাগার ঘটনা নতুন নয়। গত কয়েক বছরে এ ধরনের একাধিক ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি ছিল ভয়াবহ।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাজীপুরে একটি বাসে আগুন লেগে তিনজনের মৃত্যু হয়। একই বছর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কেও একটি বাসে আগুন ধরে যায়, যদিও তখনও যাত্রীরা অল্পের জন্য রক্ষা পান।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের কারণ হয় নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সংযোগ, ইঞ্জিন ও ব্যাটারি সিস্টেমে ত্রুটি, কিংবা রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। নিয়মিত পরিদর্শন না করা এবং পুরোনো বাসগুলোতে ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রাংশ ব্যবহারের কারণেও এমন দুর্ঘটনা বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞ মতামত: নিয়মিত পরিদর্শন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জরুরি
পরিবহন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন—
“বাংলাদেশে বেশিরভাগ বাসই পুরোনো এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। ইঞ্জিনে তেল লিক, পুরোনো তার, ব্যাটারি শর্ট সার্কিট—এসবই আগুনের বড় কারণ। বাসগুলোতে ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকলেও তা অনেক সময় মেয়াদোত্তীর্ণ বা অকেজো থাকে।”
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি যাত্রীবাহী বাসের ক্ষেত্রে বছরে অন্তত দুইবার ‘টেকনিক্যাল ইন্সপেকশন’ বাধ্যতামূলক করা উচিত। পাশাপাশি যাত্রীদের জন্য সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণও জরুরি।
সরকারি পদক্ষেপ ও পরবর্তী করণীয়
টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক মো. আবদুল হামিদ জানান, ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
“আমরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনা আর না ঘটে, সে জন্য পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে,” বলেন তিনি।
এদিকে, সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) জানিয়েছে, সারাদেশে চলমান যাত্রীবাহী বাসগুলোর মধ্যে পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ বাসগুলো পর্যায়ক্রমে বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
জনমতের প্রতিক্রিয়া
ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর সাধারণ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, কেন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে?
টাঙ্গাইলের একজন কলেজশিক্ষার্থী লিখেছেন—
“প্রতিদিন আমরা এমন খবর শুনি। অথচ কেউ দায় নেয় না। যাত্রীদের জীবন যেন কারও কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়েছে।”
চলন্ত বাসে আগুন লাগার এই ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দিল, সড়ক নিরাপত্তা কেবল আইন প্রয়োগে নয়, সচেতনতা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নেও নির্ভর করে। যাত্রী, চালক, পরিবহন মালিক—সব পক্ষকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
এই ঘটনার পর যাত্রীদের মধ্যে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে সবাই কৃতজ্ঞ যে, ভয়াবহ এক দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েও প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন তারা।
MAH – 13776 I Signalbd.com



