মেহেরপুর সদর উপজেলার এক বিলে পদ্ম ফুল তুলতে গিয়ে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছে একই পরিবারের চার কিশোরী। ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে দুজন অষ্টম শ্রেণি ও দুজন চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। ঘটনার পর গোটা এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
ঘটনাস্থল: মসুরিভাজা বিলে করুণ পরিণতি
রোববার (৯ নভেম্বর) বিকেলে মেহেরপুর সদর উপজেলার রাজনগর গ্রামের মসুরিভাজা বিলে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানান, চার কিশোরী দুপুরের দিকে পদ্ম ফুল তুলতে বিলের দিকে যায়। অনেক সময় পার হয়ে গেলেও তারা বাড়ি না ফেরায় পরিবারের সদস্যরা খোঁজ শুরু করেন। সন্ধ্যার আগে বিলের পানিতে ভাসমান অবস্থায় তাদের মরদেহ দেখতে পান এলাকাবাসী।
খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সদর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে মরদেহ উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। এ সময় শত শত মানুষ ঘটনাস্থলে জড়ো হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
নিহতদের পরিচয় ও পারিবারিক সম্পর্ক
নিহতরা হলো— অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাতেমা (১৪), চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী রাফিয়া (১০), একই শ্রেণির আলিয়া (৯) এবং অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিম (১৩)। তারা সবাই দুই আপন ভাই মজিবর রহমান ও শাহারুল ইসলামের মেয়ে।
এভাবে একই পরিবারের চার সন্তানের মৃত্যুতে গোটা গ্রামজুড়ে নেমে এসেছে শোকের মাতম।
পরিবারের সদস্যরা জানায়, শিশুরা প্রতিদিন বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে বা ফুল তুলতে বিলে যেত। কিন্তু আজকের দিনটি ছিল তাদের জীবনের শেষ বিকেল।
স্থানীয়দের বর্ণনায় কী ঘটেছিল
রাজনগর গ্রামের বাসিন্দা আজিজুল হক জানান, “দুপুরের দিকে মেয়েগুলোকে বিলের পাশে দেখেছিলাম। এরপর আর ফিরে আসেনি। সন্ধ্যার আগেই আমরা বিলের পানিতে তাদের ভাসতে দেখি। কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না এমন ঘটনা ঘটতে পারে।”
স্থানীয়দের ধারণা, পদ্ম ফুল তুলতে গিয়ে তারা বিলের গভীর অংশে নেমে যায় এবং একে অপরকে বাঁচাতে গিয়ে সবাই ডুবে যায়।
তাদের কেউই সাঁতার জানতো না বলে নিশ্চিত করেছেন পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন।
উদ্ধার অভিযান: ফায়ার সার্ভিসের ভূমিকা
মেহেরপুর ফায়ার সার্ভিসের টিম লিডার শামীম হোসেন বলেন, “আমরা খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে পৌঁছাই। স্থানীয়রা তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করে, পরে বিলে এক গর্তের মধ্যে থেকে চতুর্থজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।”
তিনি আরও বলেন, “এ ধরনের বিলগুলোতে একেক জায়গায় পানির গভীরতা একেক রকম। শিশুরা সেটা বুঝতে না পারায় দুর্ঘটনাটি ঘটে।”
পুলিশ জানায়, মরদেহগুলো উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এটিকে দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
প্রশাসনের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ ও সহায়তা
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান মেহেরপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. তরিকুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমাইয়া জাহান ঝুঁকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বলেন, “এটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ঘটনা। নিহতদের দাফনের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিটি পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা পরিবারগুলোর পাশে আছি। প্রয়োজনে আরও সহায়তা দেওয়া হবে।”
গ্রামে শোকের ছায়া ও সর্বস্তরের মানুষের সমবেদনা
ঘটনার পর থেকেই রাজনগর ও আশপাশের এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। গ্রামের মানুষ কেউই স্বাভাবিক থাকতে পারছেন না। চারটি শিশুর একসঙ্গে মৃত্যুতে শোকাহত পুরো উপজেলা।
স্থানীয় এক শিক্ষক বলেন, “ওরা সবাই ভালো ছাত্রী ছিল। নিয়মিত স্কুলে যেত। এখন ক্লাসে তাদের খালি চেয়ারগুলোই চোখে পড়ে থাকবে।”
শিশুদের মরদেহ নিজ বাড়িতে নেওয়ার পর কান্নার রোল পড়ে যায়। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী সবাই ভিড় করে তাদের শেষ দেখা দেখতে আসে।
গ্রামীণ এলাকায় নিরাপত্তা সচেতনতার অভাব
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গ্রামীণ এলাকায় বিল, পুকুর বা নদীর আশেপাশে শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
প্রতিনিয়ত এমন দুর্ঘটনা ঘটলেও যথাযথ সচেতনতা তৈরি হচ্ছে না। স্কুলের শিশুদের মধ্যে সাঁতার শেখানোর উদ্যোগ বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন স্থানীয় প্রশাসন ও শিক্ষকরা।
মেহেরপুরের এক সমাজকর্মী বলেন, “প্রতিটি পরিবারকে সচেতন হতে হবে। বাচ্চাদের একা বিল বা নদীতে যেতে দেওয়া উচিত নয়।”
শোকের দিনে শিক্ষা
একই পরিবারের চার শিশুর মৃত্যু শুধু এক গ্রামকেই নয়, পুরো জেলাকে কাঁদিয়েছে।
এই দুর্ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দিল, গ্রামীণ জীবনে অজানা বিপদের মুখে শিশুদের কতটা অসহায়।
স্থানীয়রা আশা করছেন, প্রশাসন এমন এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করবে এবং পরিবারগুলো আরও সতর্ক হবে যাতে ভবিষ্যতে এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা আর না ঘটে।
এম আর এম – ২১৫১,Signalbd.com



