আঞ্চলিক

চৌদ্দগ্রামে প্রবাসীর স্ত্রীকে বেধে মারধর, সালিশে বিয়ে

Advertisement

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নে এক প্রবাসীর স্ত্রীকে প্রকাশ্যে বেধে মারধরের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় এক ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, ওই নারীকে “অনৈতিক সম্পর্কের” অজুহাতে গ্রাম্য সালিশের নামে নির্যাতন করা হয় এবং পরদিন তাকে অন্য এক ব্যক্তির সঙ্গে জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় ২ মিনিট ৫৪ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয় বাসিন্দা ও অনলাইন ব্যবহারকারীরা।

ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া

২১ অক্টোবর মঙ্গলবার বিকেলে ভিডিওটি ফেসবুক ও টিকটকে ছড়িয়ে পড়ে। দেখা যায়, একজন নারীকে রশি দিয়ে দুই হাত পেছনে বেঁধে রাখা হয়েছে, আর ইউপি সদস্য বজলুর রহমান নিজেই হাতে লাঠি নিয়ে তাকে মারছেন। পাশে আরেকজন পুরুষকে একইভাবে বেঁধে রাখা।
ভিডিওতে নির্যাতনের সময় নারীর করুণ আর্তনাদ, “বাবা, মাইরেন না”—এই চিৎকার শুনে উপস্থিত অনেকেই কেঁপে ওঠেন।
ঘটনাটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায় এবং প্রশাসনের নজরে আসে।

ঘটনার পটভূমি

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নির্যাতনের শিকার ওই নারী গোপালনগর গ্রামের বাসিন্দা। তার স্বামী প্রবাসে থাকেন মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশে। অভিযোগ ওঠে—স্থানীয় এক ব্যক্তি, বিল্লাল মিয়া (৪৫), যিনি নিজেও বিবাহিত ও চার কন্যা সন্তানের জনক, তার সঙ্গে ওই নারীর ‘অনৈতিক সম্পর্ক’ রয়েছে।

১৬ অক্টোবর রাতে স্থানীয় কয়েকজন ওই নারী ও বিল্লালকে একসঙ্গে দেখে আটক করেন। পরে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছান ইউপি সদস্য বজলুর রহমান, যিনি শ্রীপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সহ-সভাপতি হিসেবেও পরিচিত।
সেই রাতেই বজলুর রহমানের নেতৃত্বে গ্রামের কয়েকজন যুবক নারী ও বিল্লালকে বেঁধে মারধর করেন।

সালিশে জোর করে বিয়ে

পরদিন সকালেই ইউপি সদস্যের নেতৃত্বে বসে স্থানীয় সালিশ বৈঠক। সেখানে কোনো সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি ছিল না।
গ্রাম্য সালিশের “রায়” অনুযায়ী, ওই নারীকে বিল্লাল মিয়ার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। উপস্থিত লোকজনের সামনেই কাবিন সম্পন্ন করা হয় বলে জানা গেছে।

তবে স্থানীয় অনেকেই বিষয়টি অন্যায় বলে দাবি করেন। তাদের ভাষায়,

“এটা কোনো সালিশ হতে পারে না। এটা ছিল এক ধরনের সামাজিক নিপীড়ন।”

প্রবাসীর পরিবারের কান্না

প্রবাসে থাকা স্বামী যখন ভিডিওটি দেখেন, তখন তিনি স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। ফোনে তিনি পরিবারের লোকজনকে বলেন,

“আমার স্ত্রী যদি কোনো ভুলও করে থাকে, তাকে মারার বা বেঁধে রাখার অধিকার কারও নেই। আইন আছে, আদালত আছে।”

প্রবাসীর এক আত্মীয় জানান, “আমরা এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছি। গ্রামে কেউ কিছু বললে ভয় পায়, কারণ ইউপি সদস্য বজলুর রহমান প্রভাবশালী।”

অভিযুক্ত ইউপি সদস্য আত্মগোপনে

ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পরপরই অভিযুক্ত ইউপি সদস্য বজলুর রহমান মোবাইল ফোন বন্ধ করে আত্মগোপনে চলে যান।
চৌদ্দগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিলাল উদ্দিন চৌধুরী জানিয়েছেন,

“ঘটনার ভিডিও আমাদের হাতে এসেছে। অভিযুক্ত ইউপি সদস্যকে ধরতে অভিযান চলছে। তিনি আইনের হাত থেকে রেহাই পাবেন না।”

পুলিশ জানিয়েছে, ভিডিওটি ডিজিটাল ফরেনসিক বিশ্লেষণের জন্য পাঠানো হয়েছে, যাতে নির্যাতনের সময়কার অবস্থান ও উপস্থিত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা যায়।

স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া

চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলেন,

“এমন নির্মম ও অবৈধ সালিশ মেনে নেওয়া যায় না। কেউ অপরাধ করলে বিচার হবে আদালতে, লাঠির জোরে নয়। অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা হবে।”

জেলা প্রশাসকও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন। ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

নারী নির্যাতন রোধে আইনি অবস্থান

বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অনুযায়ী, কোনো নারীকে প্রকাশ্যে অপমান, শারীরিক নির্যাতন বা জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়া গুরুতর অপরাধ।
আইনের ৯(১) ধারায় বলা আছে, নারীকে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের দায়ে সর্বোচ্চ আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া যেতে পারে।

এছাড়া সালিশের নামে “জোরপূর্বক বিয়ে” দেওয়া আইনের চোখে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে,

“এই ধরনের গ্রামীণ সালিশ আসলে আইনের বিকৃতি। এতে নারী নিপীড়নের সংস্কৃতি আরও গভীর হচ্ছে।”

মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিক্রিয়া

মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর কুমিল্লা শাখার সভাপতি বলেন,

“গ্রামীণ রাজনীতিতে প্রভাবশালী কিছু মানুষ নিজেদের ক্ষমতা দেখাতে এই ধরনের সিদ্ধান্ত দেন। এতে সমাজে ভয়াবহ বার্তা যায়—যে শক্তিশালী সে-ই বিচারক।”

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদও এক বিবৃতিতে ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং বলেছে,

“ভিডিওতে যা দেখা গেছে, তা কেবল নির্যাতন নয়, নারীর মানবাধিকার ও মর্যাদার ওপর নির্মম আঘাত।”

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনরোষ

ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর ফেসবুকে অসংখ্য মানুষ নিন্দা জানিয়ে পোস্ট দিয়েছেন।
অনেকে লিখেছেন,

“এই ধরনের সালিশ বন্ধ করতে হবে। আইন নিজের হাতে তোলা সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর।”

আরেকজন লিখেছেন,

“এটা কোনো অনৈতিক সম্পর্ক নয়, এটা ক্ষমতার অপব্যবহার। একজন নারীকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করা সভ্য সমাজে অগ্রহণযোগ্য।”

গ্রামীণ সালিশ সংস্কৃতি ও বিচারব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এখনো অনেক জায়গায় সালিশ প্রথা চালু আছে। অনেক সময় ছোটখাটো বিবাদে সালিশ কার্যকর হয়ও বটে।
কিন্তু “অনৈতিক সম্পর্ক” বা “পারিবারিক বিরোধ” নিয়ে সালিশের নামে শাস্তি দেওয়া, মারধর বা বিয়ে দেওয়া – এসব এখনো ঘটে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন,

  • সালিশ ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কর্তৃত্ব করেন।
  • নারীকে ‘দোষী’ প্রমাণ করার প্রবণতা বেশি।
  • আইনি জ্ঞানের অভাব ও ভয়-ভীতি মানুষকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রেহানা আখতার বলেন,

“এই ঘটনার মধ্যে আমরা এক ধরনের সামাজিক পশ্চাদপদতা দেখছি। একজন জনপ্রতিনিধি যদি আইন ভঙ্গ করেন, তা সমাজের জন্য আরও ভয়ঙ্কর বার্তা দেয়।”

গ্রামে এখন আতঙ্কের পরিবেশ

ঘটনার পর থেকে গোপালনগর গ্রামে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
অনেকে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি নন। স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন, অভিযুক্ত ইউপি সদস্য প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ মুখ খুললে প্রতিশোধ নেওয়া হতে পারে।

এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন,

“আমরা ভিডিও দেখে ভয় পেয়েছি। একটা নারীকে এভাবে বেঁধে মারছে, অথচ কেউ বাধা দেয় না—এটা আমাদের সমাজের ব্যর্থতা।”

সরকারি তদারকির আহ্বান

নাগরিক সমাজ ও স্থানীয় মানবাধিকারকর্মীরা প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছেন—
১️⃣ দ্রুত তদন্ত শেষ করে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করতে হবে।
২️⃣ ভুক্তভোগী নারীকে নিরাপত্তা ও আইনি সহায়তা দিতে হবে।
৩️⃣ এই ধরনের “অবৈধ সালিশ” বন্ধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়া জরুরি।

চৌদ্দগ্রামের এই ঘটনাটি শুধু একটি গ্রামীণ নির্যাতনের গল্প নয়—এটি আইনহীনতার এক নগ্ন চিত্র
যেখানে একজন নারী, একজন মা, একজন নাগরিক—আইনের বদলে লাঠির বিচারে অপমানিত হয়েছেন।

যে দেশে একজন জনপ্রতিনিধি আইন হাতে তুলে নেয়, সেখানে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে আশা করা যায়, প্রশাসন কঠোর অবস্থান নেবে এবং এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করবে—যাতে আর কোনো নারীকে গ্রামীণ “সালিশের” নামে এমন অমানবিক নির্যাতনের শিকার হতে না হয়।

MAH – 13432 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button