আঞ্চলিক

ভয়াবহ দুর্ঘটনায় লোহাগাড়ায় দুই তরুণের প্রাণহানি

Advertisement

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায় চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী প্রাণ হারিয়েছেন। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) দিবাগত রাত আনুমানিক ২টার দিকে পুরাতন বিওসি এলাকার সুজুকি শোরুমের সামনে ঘটে এ দুর্ঘটনা। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষায়, ঘটনাস্থল মুহূর্তেই পরিণত হয় মৃত্যুকূপে।

দুর্ঘটনাস্থলটি লোহাগাড়া থানার ব্যস্ততম এলাকা, যেখানে রাতে ভারী যান চলাচল প্রায়ই দেখা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, একটি দ্রুতগতির অজ্ঞাত গাড়ি মোটরসাইকেলটিকে সজোরে ধাক্কা দিলে তারা রাস্তার পাশে ছিটকে পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।

নিহত দুইজনের পরিচয়

নিহতরা হলেন—

  • মো. সোহেল (২৫), পিতা: ফারুক, বাড়ি কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায়।
  • মো. আবু বক্কর সিদ্দিক (১৪), পিতা: আব্দুর রহমান, বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার ভূজপুর এলাকায়।

জানা যায়, নিহত সোহেল চট্টগ্রাম শহরের এক ব্যবসায়ী ছিলেন এবং দুই সন্তানের জনক। তিনি ব্যবসায়িক কাজ শেষে মোটরসাইকেলে করে চকরিয়া যাচ্ছিলেন। অপরজন আবু বক্কর ছিলেন তাঁর পরিচিত ও দোকানের কর্মচারী। চাকরি শেষ করে তিনি মালিকের সঙ্গে যাচ্ছিলেন শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আর ফেরা হলো না তাদের।

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা

একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান,

“রাত প্রায় দুইটার দিকে হঠাৎ এক বিকট শব্দ শুনে বাইরে ছুটে যাই। দেখি দুইজন রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে। আশপাশের লোকজন ছুটে আসে, কিন্তু তাদের বাঁচানোর সুযোগ ছিল না। ঘটনার পর মুহূর্তেই খবর দেওয়া হয় পুলিশকে।”

ঘটনার পর স্থানীয়রা আতঙ্কে হতভম্ব হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর লোহাগাড়া থানা ও দোহাজারী হাইওয়ে থানার যৌথ টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধার করে।

পুলিশের বক্তব্য

দোহাজারী হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মাহবুব রুহুল আমিন জানান,

“সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই দুই মোটরসাইকেল আরোহী মারা যান। আমরা খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে যাই এবং আইনি প্রক্রিয়া শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।”

উপ-পরিদর্শক (এসআই) রুহুল আমিন বলেন,

“দুর্ঘটনাকবলিত মোটরসাইকেলটি হাইওয়ে থানার হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। অজ্ঞাত গাড়িটি শনাক্তের জন্য সড়কের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহের কাজ চলছে। আশা করছি খুব দ্রুতই গাড়িটি শনাক্ত করা সম্ভব হবে।”

অজ্ঞাত গাড়ির সন্ধান ও তদন্ত

পুলিশ জানায়, দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল থেকে গাড়িটি দ্রুত পালিয়ে যায়। এলাকাটির পাশে থাকা কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পেট্রোলপাম্পের সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজ বিশ্লেষণ করে গাড়ির ধরন ও রঙ শনাক্তের চেষ্টা চলছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এটি একটি ভারী পণ্যবাহী ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যান ছিল।

এদিকে নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে অজ্ঞাত গাড়িচালকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। স্থানীয় বাসিন্দারা দাবি জানিয়েছেন, রাতের বেলা মহাসড়কে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে প্রায়ই এমন দুর্ঘটনা ঘটছে, যা নিয়ন্ত্রণে না আনলে আরও প্রাণহানি ঘটতে পারে।

সড়ক দুর্ঘটনায় উদ্বেগজনক বৃদ্ধি

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির ২০২৫ সালের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৩,৮০০টির বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৪,৭০০ জন নিহত এবং ৫,২০০ জন আহত হয়েছেন।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি দেশের অন্যতম ব্যস্ততম সড়ক। পর্যটন গন্তব্য কক্সবাজারে যাতায়াতের মূল রুট হওয়ায় দিনরাতই এখানে যানবাহনের চাপ থাকে। রাতের বেলায় অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো, ক্লান্ত চালক, ও ওভারটেকিং প্রবণতাই মূলত এসব দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

স্থানীয়দের ক্ষোভ ও দাবি

দুর্ঘটনার পর স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন—

“প্রায়ই এখানে দুর্ঘটনা ঘটে। রাতে গাড়িগুলো অনেক বেশি গতিতে চলে। পুলিশ বা হাইওয়ে টহল থাকলেও গতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। আমাদের এলাকার মানুষ প্রতিদিন আতঙ্কে থাকে।”

তাদের দাবি,

  • মহাসড়কের পুরাতন বিওসি এলাকায় গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা স্থাপন করতে হবে।
  • সিসিটিভি ও স্পিড মনিটরিং ক্যামেরা বাড়াতে হবে।
  • রাতের বেলা হাইওয়ে টহল বাড়ানো এবং নিয়মিত চালক মাদক পরীক্ষা চালু করতে হবে।

নিহত পরিবারের আর্তনাদ

নিহত সোহেলের পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। দুই সন্তান ও স্ত্রী বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। পরিবারের সদস্যরা বলেন,

“সোহেল খুব পরিশ্রমী ছিল। বাচ্চাদের ভালো ভবিষ্যতের জন্য সারাদিন পরিশ্রম করত। কিন্তু একটা বেপরোয়া গাড়ির কারণে সব শেষ হয়ে গেল।”

অন্যদিকে আবু বক্করের পরিবারের সদস্যরাও শোকে মূহ্যমান। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই পরিবারের অন্যতম উপার্জনকারী ছিল সে। তারা সরকারের কাছে ন্যায়বিচার ও দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন।

বিশেষজ্ঞ মতামত: সড়ক নিরাপত্তায় করণীয়

সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. কাজী আসিফ উদ্দিন বলেন,

“রাতের দুর্ঘটনা কমাতে হলে প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ও কঠোর শাস্তি জরুরি। হাইওয়ে পুলিশের টহল আরও সক্রিয় করতে হবে। পাশাপাশি, মহাসড়কে লাইটিং, স্পিড ব্রেকার ও রিফ্লেক্টিভ সাইনবোর্ডের সংখ্যা বাড়াতে হবে।”

তিনি আরও বলেন,

“চালকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা দরকার। অনেক চালক ক্লান্ত অবস্থায় গাড়ি চালান, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়।”

সরকারের পদক্ষেপ

সরকার ইতিমধ্যে “রোড সেফটি স্ট্রাটেজি ২০২৫–২০৩০” পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা ৫০% কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আওতায় নতুন স্মার্ট হাইওয়ে সিসিটিভি সিস্টেম, ডিজিটাল ড্রাইভার মনিটরিং এবং স্বয়ংক্রিয় গতিনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালুর কাজ চলছে।

তবে বাস্তবায়নে ধীরগতি ও স্থানীয় পর্যায়ে নজরদারির অভাবই এসব দুর্ঘটনার মূল বাধা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আবারও প্রমাণ করল, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে প্রতিদিনই এভাবে প্রাণ হারাবে নিরীহ মানুষ। অজ্ঞাত গাড়ির ধাক্কায় দুই তরুণের মৃত্যু শুধু দুটি পরিবার নয়, পুরো সমাজকেই নাড়া দিয়েছে।
সড়ক ব্যবস্থাপনা, আইন প্রয়োগ ও চালকদের সচেতনতা—এই তিন দিকেই এখন জোর দিতে হবে।
প্রতিটি মৃত্যু যেন আর একটি পরিসংখ্যানে সীমাবদ্ধ না থাকে, সেটিই হোক এই দুর্ঘটনা থেকে পাওয়া শিক্ষা।

MAH – 13355 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button