বিশ্ব

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতের ‘গণহত্যা’ মামলায় যোগ দিচ্ছে ব্রাজিল

Advertisement

২০২৫ সালের ২৩ জুলাই, সাউথ আমেরিকার বৃহৎ দেশ ব্রাজিল ঘোষণা করেছে, তারা আন্তর্জাতিক আদালত, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক ন্যায়িক আদালত (International Court of Justice – ICJ) এ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজা অঞ্চলে সংঘটিত ‘গণহত্যা’ মামলা নিয়ে আনুষ্ঠানিক হস্তক্ষেপ করবে। দক্ষিণ আফ্রিকা যে মামলাটি গত বছর দায়ের করেছিল, সেখানে ব্রাজিল এখন ‘সহযোগী’ হয়ে পরিস্থিতির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নৈতিক ও আইনি চাপ বাড়াচ্ছে।

ব্রাজিলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “চলমান নৃশংসতা ও গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আর নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। নৈতিক দ্বিধা কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার কারণে আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা অন্যায়। দায়মুক্তি আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি আস্থা নষ্ট করে এবং বিশ্ব শান্তি-ব্যবস্থার জন্য হুমকি।”

গাজায় সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন: ব্রাজিলের দৃঢ় প্রতিক্রিয়া

ব্রাজিল সরকার গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান বেহাল মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সহিংসতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষত উল্লেখযোগ্য হলো, খাদ্য সংকটকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার ‘ন্যক্কারজনক’ কৌশল, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন।

ব্রাজিলের এই সিদ্ধান্ত স্পেন, তুরস্ক, আয়ারল্যান্ডসহ অন্যান্য কয়েকটি দেশের পদক্ষেপের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যারা ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক আদালতে এই মামলায় হস্তক্ষেপের জন্য আবেদন করেছে। তারা আইসিজেকে আহ্বান জানাচ্ছে, যেন ১৯৪৮ সালের গণহত্যা প্রতিরোধ ও শাস্তি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির ভিত্তিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

ব্রাজিলের নীতি ও বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া

২০২৫ সালের ব্রিকস সম্মেলনে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা স্পষ্টভাবে ইসরায়েলের গাজা অভিযানের নিন্দা জানিয়ে তাকে ‘গণহত্যাকারী’ আখ্যা দিয়েছিলেন। এরপর থেকে ব্রাজিলের কণ্ঠস্বর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তীব্র এবং সুস্পষ্ট হয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা প্রতিরোধ ও সুরক্ষার অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, যার জন্য আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আইসিজের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

ইসরায়েল ও ব্রাজিলিয়ান ইহুদি সংগঠনের প্রতিবাদ

ব্রাজিলের এই উদ্যোগে ইসরায়েলের দূতাবাস সরাসরি বিরক্তি প্রকাশ করেছে। তারা ব্রাজিলের বিবৃতিকে ‘অতিরঞ্জিত ও বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন’ বলেছে এবং হামাসের ভূমিকাকে উপেক্ষা করার অভিযোগ তুলেছে। একই সঙ্গে ব্রাজিলের জাতীয় ইহুদি সংগঠন ‘কনিব’ এই সিদ্ধান্তকে ‘অতিমাত্রায় রাজনৈতিক’ ও ‘অসঙ্গত’ বলে মন্তব্য করেছে। তারা বলেছে, “ব্রাজিলের সঙ্গে ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”

আন্তর্জাতিক ন্যায়িক আদালতের ভূমিকা ও সাম্প্রতিক রায়

আইসিজে এখনো গাজায় গণহত্যার বিষয়ে চূড়ান্ত রায় দেনি, তবে গত ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে তারা আদেশ দিয়েছিল ইসরায়েলকে গাজার মানুষের জন্য মানবিক সাহায্যের প্রবেশের সুযোগ বাড়াতে হবে। যদিও এই আদেশ কার্যকর হয়নি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলের প্রতি কঠোর সমর্থন জানিয়েছে।

তবে, বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থা ও বিশ্লেষকরা ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন’ বলে সতর্কতা জারি করেছে।

গাজায় খাদ্য ও মানবিক অবস্থা: অবরোধ ও সংকটের গল্প

২০২৫ সালের মার্চ থেকে ইসরায়েল গাজার ওপর সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করেছে, ফলে কয়েক মাস ধরে কোনো মানবিক সহায়তা প্রবেশ করতে পারেনি। তবে পরে একটি মানবিক সংস্থা ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ) সীমিত আকারে সহায়তা বিতরণ শুরু করে।

যদিও, এই কেন্দ্রগুলোতে খাদ্যের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে থাকা ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনী হামলা চালিয়েছে, যার ফলে শতাধিক ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কর্মকর্তারা এই সহায়তা কেন্দ্রগুলোকে ‘মৃত্যুর ফাঁদ’ বলে অভিহিত করেছেন এবং অনেক আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা এই কার্যক্রম থেকে সরে গেছেন।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মানবাধিকার সংগঠনের চ্যালেঞ্জ

গাজার সংকট ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভক্ত মনোভাব স্পষ্ট। পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলের পক্ষপাতিত্ব করছে, আবার বহু দেশ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার অভিযোগ তোলার মাধ্যমে আইনি ও কূটনৈতিক চাপে জোর দিচ্ছে।

ব্রাজিলের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও মানবাধিকার সংরক্ষণের জন্য নতুন আশা জাগিয়েছে। আইসিজের মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলায় সহায়তার ঘোষণা ভবিষ্যতে অন্য দেশকেও এই সংগ্রামে এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করবে বলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।

সিগন্যালবিডি’র জন্য বিশেষ রিপোর্ট:

গাজায় গণহত্যার অভিযোগ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

  • ব্রাজিলের হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধিতে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
  • মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনের কার্যকর প্রয়োগের প্রয়োজন।
  • গাজার অবরোধ ও খাদ্য সংকটের মানবিক পরিণতি বিশ্বমঞ্চে গুরুত্ব পাচ্ছে।
  • পশ্চিমা ও উন্নয়নশীল দেশের দ্বন্দ্ব ও প্রতিক্রিয়া এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক কেন্দ্রীয় বিষয়।

ব্রাজিলের এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইসরায়েলের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের দাবি ও মানবাধিকার রক্ষায় একটি শক্তিশালী সংকেত। গাজার মানবিক বিপর্যয় ও চলমান সংঘাতের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা জাগিয়েছে।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button