দেশের বাজারে আবারও স্বর্ণের দাম বেড়েছে। সর্বোচ্চ মানের ২২ ক্যারেট স্বর্ণের ভরিতে দাম পৌঁছেছে এক লাখ ৮৫ হাজার ৯৪৭ টাকায়, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণের সর্বোচ্চ দাম। বাজুসের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) থেকে এই মূল্য কার্যকর হবে।
নতুন দাম ঘোষণার বিস্তারিত
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি দেশের বাজারে পড়েছে। সেই সঙ্গে স্থানীয় বাজারে তেজাবি স্বর্ণের (পিওর গোল্ড) মূল্য বেড়ে যাওয়ায় সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।
নতুন দামে প্রতি ভরি (১১.৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণের দাম হলো—
- ২২ ক্যারেট: ১,৮৫,৯৪৭ টাকা
- ২১ ক্যারেট: ১,৭৭,৫০৩ টাকা
- ১৮ ক্যারেট: ১,৫২,১৪৫ টাকা
- সনাতন পদ্ধতি: ১,২৬,১৪৬ টাকা
এছাড়া স্বর্ণের বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে সরকার নির্ধারিত ৫ শতাংশ ভ্যাট এবং বাজুস নির্ধারিত ন্যূনতম ৬ শতাংশ মজুরি যুক্ত করতে হবে। তবে গহনার ডিজাইন ও মানভেদে মজুরির তারতম্য হতে পারে।
গত এক বছরে স্বর্ণের বাজারে ধারাবাহিক উত্থান লক্ষ্য করা গেছে। এর আগে গত ৮ সেপ্টেম্বর প্রতি ভরিতে ১ হাজার ২৬০ টাকা বাড়িয়ে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম দাঁড়িয়েছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ৮১০ টাকা। কিন্তু মাত্র এক দিনের ব্যবধানে আরও ৩ হাজার টাকার বেশি বাড়িয়ে দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হলো।
বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণের দাম এত বেশি আগে কখনও হয়নি। সাধারণত আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামা, ডলার সংকট এবং আমদানির খরচ বৃদ্ধিই স্থানীয় বাজারে মূল্যের পরিবর্তনের প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়।
স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও সাধারণ ক্রেতার প্রতিক্রিয়া
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে অনিশ্চয়তা ও ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে স্থানীয় বাজারে স্বর্ণের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। অনেক ক্রেতা স্বর্ণ কেনার আগ্রহ দেখালেও উচ্চমূল্যের কারণে তারা পিছিয়ে যাচ্ছেন।
একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী জানান, “আমাদের পক্ষে ক্রেতাদের বোঝানো কঠিন হয়ে পড়ছে। তারা মনে করছেন আমরা ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছি। অথচ বাস্তবে আন্তর্জাতিক বাজারের দাম বৃদ্ধিই এর জন্য দায়ী।”
অন্যদিকে সাধারণ ক্রেতারা বলছেন, বিয়ে বা বিশেষ অনুষ্ঠানে স্বর্ণ কেনার পরিকল্পনা থাকলেও বাড়তি দামের কারণে তা আর সম্ভব হচ্ছে না। অনেকেই বিকল্প হিসেবে সিলভার বা হালকা গহনা কেনার দিকে ঝুঁকছেন।
অর্থনীতিতে প্রভাব
স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধি শুধু গহনা ক্রেতাদের জন্যই নয়, পুরো অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলছে। স্বর্ণ সাধারণত নিরাপদ বিনিয়োগের একটি মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়। দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক বিনিয়োগকারী স্বর্ণ কেনার দিকে ঝুঁকছেন। এতে বাজারে চাহিদা আরও বেড়ে যাচ্ছে এবং মূল্যবৃদ্ধির চাপ অব্যাহত থাকছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি যখন ডলার সংকটে ভুগছে, তখন স্বর্ণ আমদানির খরচও বেড়ে গেছে। এর প্রভাব সরাসরি খুচরা বাজারে পড়ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব
বিশ্ববাজারে চলতি মাসে স্বর্ণের দাম প্রতি আউন্সে রেকর্ড ছুঁয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সরিয়ে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে স্বর্ণে বিনিয়োগ করছেন। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য হঠাৎ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্বর্ণের দাম স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরতে হলে আন্তর্জাতিক বাজারের স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। তারা মনে করেন, স্থানীয় বাজারে মূল্যনিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এছাড়া আমদানি ব্যয় কমানোর জন্য সরকারকে ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে হবে।
এক অর্থনীতিবিদ বলেন, “স্বর্ণের দাম সর্বকালের সর্বোচ্চ হওয়া সাধারণ ক্রেতাদের জন্য দুঃসংবাদ। দীর্ঘমেয়াদে এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে বাজারে মন্দাভাব তৈরি হতে পারে।”
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিকট ভবিষ্যতে স্বর্ণের দাম আরও কিছুটা বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের স্বাভাবিকতা ফিরলে স্থানীয় বাজারেও মূল্য কিছুটা কমতে পারে। ক্রেতাদের এখন সতর্ক হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামে পৌঁছানো স্বর্ণ বাজারে নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। আন্তর্জাতিক বাজার, ডলার সংকট ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মিলিয়ে মূল্যবৃদ্ধির এই ধারা তৈরি হয়েছে। এখন সবার চোখ আন্তর্জাতিক বাজারের দিকে—সেখানকার পরিবর্তনই নির্ধারণ করবে দেশের স্বর্ণবাজারের ভবিষ্যৎ।
এম আর এম – ১২৫৫,Signalbd.com



