সিলেটের ওসমানী মেডিকেলে দালাল ও চোর চক্রের দৌরাত্ম্য

সরকারি হাসপাতালের ভেতরে চলমান দালাল ও চোর চক্রের সক্রিয়তা এখন উদ্বেগজনক। ওষুধ কেনার ফাঁদে ফেলে রোগীর স্বজনদের প্রতারণা, মোবাইল-মানিব্যাগ চুরি, এমনকি হাসপাতাল স্টাফদের সঙ্গেও যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে। প্রশাসনিক উদ্যোগ থাকলেও তেমন পরিবর্তন আসেনি।
রোগী ও স্বজনদের নিশানা করছে প্রতারক চক্র
সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিবেশ আজ ভয়ংকর রকমের অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা প্রতিদিনই দালাল ও চোর চক্রের খপ্পরে পড়ছেন। এসব প্রতারকচক্র নানা ছলচাতুরির মাধ্যমে ওষুধ কিনে দেওয়ার নাম করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এবং কখনো কখনো মোবাইল বা মানিব্যাগও চুরি করছে।
সম্প্রতি কানাইঘাটের এক মা তার ছেলের জন্য ওষুধ কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ফার্মেসিতে নিয়ে গিয়ে টাকা হাতিয়ে এক যুবক পালিয়ে যায়। অন্যদিকে এক রোগীর স্বজন একটি ওষুধের জন্য ৩২৬০ টাকা চাওয়ার পর সন্দেহ হলে অন্য দোকান থেকে সেটি মাত্র ১৩৫০ টাকায় কেনেন।
দীর্ঘদিনের সমস্যা, কিন্তু প্রতিকার নেই
হাসপাতালে দালাল ও চোরদের দৌরাত্ম্য নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরেই তারা হাসপাতালের পরিবেশকে বিপজ্জনক করে তুলেছে। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের আউটসোর্সিং কর্মচারী, নার্স এমনকি নিরাপত্তা কর্মীদের কেউ কেউ এসব চক্রের সঙ্গে যুক্ত।
স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী, এসব দালাল ও চোর প্রতিদিন পুলিশ ও আনসার সদস্যদের নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে ‘প্রটেকশন’ পেয়ে থাকে। ফলে চিহ্নিত অপরাধীরাও নির্বিঘ্নে হাসপাতালে ঘোরাফেরা করছে।
হাসপাতালের নিরাপত্তা ফাঁড়ির ইনচার্জ অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, দাবি করেছেন নিয়মিত অভিযানে তারা দালাল ও চোরদের আটক করে থাকেন।
সিন্ডিকেটে সক্রিয় ২০–২৫ জন চক্র সদস্য
হাসপাতালের আশপাশে গড়ে ওঠা কিছু ফার্মেসিকে কেন্দ্র করেই দালাল সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। মালিপাড়া গলির আটটি ফার্মেসিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি সংগঠিত চক্র। সাইফুল, কামরুল, মানিক, সুহেল, শাহিনসহ প্রায় ২৫ জন নিয়মিত রোগীদের প্রলোভনে ফেলে টাকা আদায় করে।
তাদের কৌশল হলো, রোগীর স্বজনদের আস্থায় নিয়ে ওষুধের দাম বেশি বলিয়ে দেওয়া এবং পরে অল্প দামে কিনে আংশিক ওষুধ দিয়ে বাকিটা না দেওয়া। আবার কেউ কেউ তো সোজা টাকা নিয়েই গা ঢাকা দেয়।
হাসপাতালের সেবাব্যবস্থায় প্রভাব ও সাধারণ মানুষের হতাশা
এই দালালচক্র ও চোরদের কারণে হাসপাতালের সার্বিক সেবাব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন রোগী ও স্বজনরা। চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনায় আতঙ্কে থাকছেন সবাই। এমনকি হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকেও ওষুধ, ফোন, টাকা চুরি হওয়া নতুন কিছু নয়।
রোগী কল্যাণ সমিতির দাতা সদস্য আবদুল জব্বার জলিল বলেন, “হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চাইলে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। নজরদারি বাড়াতে হবে।”
পরিসংখ্যান ও বাস্তব চিত্র
৯০০ শয্যার এই হাসপাতালটিতে প্রতিদিন ভর্তি রোগী থাকেন প্রায় আড়াই হাজার, এর বাইরে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন সমসংখ্যক মানুষ। এমন বিশাল ভিড়ে কে রোগী, কে স্বজন আর কে দালাল — তা চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
১, ৩, ৬, ১১, ১৫, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে সবচেয়ে বেশি চুরি হয়। এমনকি হাসপাতাল কর্মীদের মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেলও চুরি হয়েছে একাধিকবার। দালালদের কাছে রোগীর স্লিপ চলে গেলে তারা সেটা নিয়ে স্বজনদের প্রতারিত করে। ৭০০ টাকার ওষুধ ৭ হাজার টাকায় বিক্রির অভিযোগও রয়েছে।
সাম্প্রতিক উদ্যোগ: বিশেষ পাস কার্ড চালুর চেষ্টা
দালাল ও চোরদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে কর্তৃপক্ষ ‘বিশেষ পাস কার্ড’ চালু করেছে। এক রোগীর সঙ্গে একজন স্বজন প্রবেশের নিয়ম চালু করার চেষ্টা চলছে। এই পাস কার্ড ছাড়াই এখন কেউ হাসপাতালে প্রবেশ করতে পারছে না। তবে বাস্তবে এই ব্যবস্থা কতটা কার্যকর, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, “পাস কার্ড চালু হলে কিছুটা সুফল মিলেছে, কিন্তু সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে কঠোর অভিযান চালাতে হবে।”
“একজন রোগীর সঙ্গে পাঁচজন স্বজন এলে চোর আর দালাল আলাদা করা যায় না”—ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া, পরিচালক, ওসমানী মেডিকেল হাসপাতাল
সারসংক্ষেপ
সিলেটের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল হিসেবে ওসমানী মেডিকেল চিকিৎসার আশ্রয়স্থল হলেও এর চারপাশে গড়ে ওঠা চোর ও দালাল চক্রের কারণে সেবা প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। প্রশাসনের কিছু উদ্যোগ থাকলেও সিন্ডিকেট ভাঙতে কার্যকর অভিযান, নজরদারি ও স্বচ্ছতা জরুরি।
প্রশ্ন হলো, এত অভিযোগের পরও কেন চিহ্নিত অপরাধীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে? জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে এবার প্রশাসনের আরও কঠোর পদক্ষেপ কি আশা করা যায়?
এম আর এম – ০৪২৩, Signalbd.com