ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জগন্নাথ হলের নবনির্মিত রবীন্দ্র ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে মৃত্যু হয়েছে নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সঞ্জু বারাইকের। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি আবেগঘন পোস্ট দেন তিনি। সেই পোস্টে ছিল আত্মপক্ষ সমর্থন, ভুলের স্বীকারোক্তি এবং ক্ষমা প্রার্থনা।
ভোরে ঘটে মর্মান্তিক পরিণতি
১৪ জুলাই সোমবার ভোর ৪টা ১০ মিনিটের দিকে জগন্নাথ হলের নবনির্মিত রবীন্দ্র ভবনের ছাদে যান সঞ্জু। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে তাকে ছাদে যেতে দেখা যায়। কিছুক্ষণ পরই নিচে তার নিথর রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে এবং মরদেহটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়।
জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ দেবাশীষ পাল জানিয়েছেন, “সঞ্জু কিছুদিন ধরে মানসিক চাপে ভুগছিল। তার বন্ধুরা জানিয়েছে, গত দুই দিন হলে ছিল না। হয়তো ভেতরে ভেতরে যুদ্ধ করছিল সে।”
শেষ ফেসবুক পোস্টে সঞ্জুর অনুভব:
ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগে রাত আনুমানিক ১১টার দিকে ফেসবুকে একটি দীর্ঘ পোস্ট দেন সঞ্জু। সেখানে তিনি লেখেন:
“আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি, আমি দিনের পর দিন কাউকে ডিস্টার্ব করে গেছি, উল্টো মানুষকে দোষারোপ করা আমার একদম ঠিক হয়নি, আমি সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমি দিনের পর দিন অন্যায় করেছি, নিজের দোষ ঢেকে অপরজনকে দোষ দেওয়া আমার ঠিক হয়নি। আমি সকলের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি, আমার কারণে কারও কোনো ক্ষতি হলে সেই দায় একান্তই আমার, আমি ক্ষমা চাচ্ছি।”
এই পোস্ট থেকে ধারণা করা যাচ্ছে যে, তিনি গভীর মানসিক সংকটে ছিলেন। পোস্টে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম উল্লেখ না থাকলেও এর ভাষা থেকে বোঝা যায়, সঞ্জু নিজেকে নিয়ে গভীর অনুশোচনায় ভুগছিলেন।
সঞ্জুর পরিচয়: ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতিশীল এক মুখ
সঞ্জু বারাইক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। থাকতেন ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ হলে। তাঁর বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায়।
সহপাঠীদের ভাষ্যমতে, তিনি ছিলেন ভদ্র, মেধাবী এবং অন্তর্মুখী স্বভাবের। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বিষয়ে মানসিক অস্থিরতা লক্ষ্য করা গেলেও, কেউ কল্পনাও করেননি এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তিনি।
মনোবিজ্ঞানী মতামত: এমন পোস্টগুলো উপেক্ষা নয়, গুরুত্ব দেওয়া উচিত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবা হক বলেন, “এই ধরনের পোস্টকে আমরা অনেক সময় ‘attention seeking’ বলে এড়িয়ে যাই। কিন্তু বাস্তবে, এগুলো অনেক সময় আত্মহত্যার ইঙ্গিত দেয়। মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা এখন সময়ের দাবি।”
তিনি আরও বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত কাউন্সেলিং সার্ভিস থাকা উচিত এবং ছাত্রদের মানসিক চাপ নিয়ে খোলামেলা আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।”
পরিবারের অপেক্ষায় এক নিঃসীম শোক
সঞ্জুর মৃত্যুর খবর পেয়ে তার পরিবার হবিগঞ্জ থেকে ঢাকায় রওনা দিয়েছে। পরিবার এখনও শোকাহত এবং কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খালিদ মুনসুর জানিয়েছেন, “সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, তিনি নিজেই ছাদে উঠে গেছেন। আত্মহত্যা বলেই মনে হচ্ছে। তবে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। তদন্তের পর বিস্তারিত জানা যাবে।”
কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় এমন ঘটনা?
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠছে বারবার। শিক্ষার্থী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হলে কাকে জানাবে, কোথায় যাবে — এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু ক্লাস-পরীক্ষা নয়, বরং মানসিক ও সামাজিক শিক্ষা দেওয়াও আজকের দিনে জরুরি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন কোনো পোস্ট দেখলে বা বন্ধুকে হতাশ মনে হলে দেরি না করে কথা বলা, পাশে থাকা, কাউন্সেলিংয়ের জন্য উৎসাহ দেওয়া—এগুলোই হতে পারে প্রাণ বাঁচানোর ছোট ছোট উপায়।
“এই ধরনের পোস্ট মানসিক যন্ত্রণার শেষ চিহ্ন হতে পারে—এগুলো উপেক্ষা নয়, সহমর্মিতার সাড়া পাওয়া উচিত”—ড. মাহবুবা হক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রশ্ন রেখে গেলেন সঞ্জু
সঞ্জুর মৃত্যু কেবল একটি আত্মহত্যা নয়, বরং এটি একটি বার্তা, একটি প্রশ্ন—আমরা কী আমাদের চারপাশের মানুষকে যথেষ্ট শুনি? সহানুভূতির জায়গা তৈরি করি? মানসিক যন্ত্রণার সংকেতগুলো বুঝতে পারি?
বিশ্লেষকদের মতে, এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে, তার জন্য প্রতিষ্ঠান, পরিবার এবং সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগ এখন সময়ের চাহিদা।
এম আর এম – ০৩৩১, Signalbd.com



