আম চাষের জন্য বাংলাদেশি চাষীদের বিনামূল্যে জমি দেবে আলজেরিয়া

আন্তর্জাতিক কৃষি সহযোগিতার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও আলজেরিয়া। আলজেরিয়া সরকার ঘোষণা দিয়েছে, তারা বাংলাদেশি কৃষকদের নিজেদের দেশে আম চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য বিনামূল্যে জমি বরাদ্দ দেবে। শুধু জমিই নয়, সেচ, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোও নিশ্চিত করা হবে এই প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী কৃষকদের জন্য। এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে কৃষি বাণিজ্য ও বিনিয়োগের এক নতুন অধ্যায় সূচিত হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কনফারেন্সে বড় ঘোষণা
শুক্রবার (২৭ জুন) বিকেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক কনফারেন্সে এই ঘোষণা দেন ঢাকায় নিযুক্ত আলজেরিয়ার রাষ্ট্রদূত ড. আবদেলোহাব সাইদানি। কনফারেন্সের আয়োজন করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং বাংলাদেশ-আলজেরিয়া বিজনেস ফোরাম (বিএবিএএফ)।
এই সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ছিল ‘কৃষি-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের সুযোগ অন্বেষণ ও কৃষিভিত্তিক আম প্রক্রিয়াকরণ’। আলোচনায় উঠে আসে কীভাবে দুই দেশের কৃষি খাতে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে পারস্পরিক লাভবান হওয়া যায়।
রাষ্ট্রদূত জানান, “আমরা বাংলাদেশি কৃষকদের আলজেরিয়ায় আম চাষে উৎসাহিত করতে চাই। আমাদের দেশে উর্বর জমির কোনো ঘাটতি নেই, তবে কৃষি শ্রমিক ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞ কৃষকরা আমাদের জন্য সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারেন।”
বিনামূল্যে জমি ও সুবিধা
আলজেরিয়া সরকার প্রস্তাব করেছে যে, বাংলাদেশি কৃষকরা চাইলে সেখানে নির্দিষ্ট এলাকায় জমি বরাদ্দ পাবেন। এই জমিতে চাষ করতে কোনো জমি ভাড়া দিতে হবে না। পাশাপাশি সেচ ব্যবস্থার জন্য পানির নিশ্চয়তা এবং বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থাও থাকবে।
এই সুবিধাগুলোর আওতায় থাকবে—
- প্রাকৃতিক সেচব্যবস্থা ও সোলার-পাওয়ারচালিত সেচ প্রযুক্তি
- কৃষিকাজের জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ
- প্রশিক্ষণ ও কৃষিপ্রযুক্তি সহায়তা
- স্থানীয় বাজারে পণ্যের প্রবেশাধিকার
রাষ্ট্রদূত জানান, আলজেরিয়ায় উৎপাদিত আম ও আমজাত পণ্য তারা নিজ দেশে গ্রহণ করবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারেও সরবরাহে সহায়তা করবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে আধুনিক কোল্ড স্টোরেজ
রাষ্ট্রদূত ড. সাইদানি এ সময় আরও জানান, তারা চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি কোল্ড স্টোরেজ ও আধুনিক আম প্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তি কেন্দ্র স্থাপন করতে চায়। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে এবং বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এই কেন্দ্রের মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম কৃষকদের উৎপাদিত ফল দীর্ঘদিন সংরক্ষণ ও বিদেশে রপ্তানির উপযোগী করে তোলা সম্ভব হবে। বর্তমানে দেশে পর্যাপ্ত হিমাগারের অভাবে প্রচুর পরিমাণে আম নষ্ট হয়, বিশেষ করে মৌসুম শেষে।
চেম্বার নেতৃবৃন্দ জানান, যদি এই কোল্ড স্টোরেজ বাস্তবায়ন হয়, তাহলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর কৃষকরা ব্যাপকভাবে উপকৃত হবেন।
প্রতিনিধি দলের আমবাগান পরিদর্শন
কনফারেন্স শেষে রাষ্ট্রদূত সাইদানি চাঁপাইনবাবগঞ্জের দুটি আমবাগান ঘুরে দেখেন। তিনি সেখানে স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং তাদের কাছ থেকে আম উৎপাদনের পদ্ধতি, জাত, বাজারজাতকরণ ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানতে চান।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন—
- বিএবিএএফ সভাপতি নূরুল মোস্তফা
- সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার
- কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ড. ইয়াছিন আলী
- চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বারের সিনিয়র সহসভাপতি খায়রুল ইসলাম
- সহসভাপতি আখতারুল ইসলাম রিমন
- পরিচালক রাইহানুল ইসলাম লুনা প্রমুখ।
রাষ্ট্রদূতের সফর শেষে এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, “বাংলাদেশের সঙ্গে আলজেরিয়ার কৃষি ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও গভীর করতে দুই দেশ আগ্রহী। আম উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণকে কেন্দ্র করে এই সম্পর্কের প্রথম ধাপ শুরু হয়েছে।”
সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত
বাংলাদেশের কৃষকরা যদি আলজেরিয়ার প্রস্তাবকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারেন, তবে এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশি আমের একটি নতুন ব্র্যান্ড তৈরি করা সম্ভব।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের একজন প্রবীণ আমচাষী মো. হায়দার আলী বলেন, “এটা আমাদের জন্য দারুণ এক সুযোগ। আমাদের অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু জায়গার সংকট ও আধুনিক সংরক্ষণ প্রযুক্তির অভাব বড় সমস্যা। আলজেরিয়ার সহযোগিতা আমাদের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে।”
নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা জরুরি
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এখন প্রয়োজন সরকারের উচ্চপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের সক্রিয় ভূমিকা। কৃষি মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় করে একটি যৌথ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা গেলে এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে গতি আসবে।
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের আমের চাহিদা বাড়ছে। ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, মেক্সিকোর মতো দেশ রপ্তানিতে অনেক এগিয়ে থাকলেও বাংলাদেশ এখনো তা পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারেনি।
আলজেরিয়ার এই প্রস্তাব কার্যকর হলে শুধু কৃষি খাত নয়, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ লাভবান হবে।