আঞ্চলিক

বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গা চুক্তি সংশোধন চায় ভারত

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সিন্ধু নদী চুক্তি স্থগিতের পর এবার বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কেও নতুন এক উত্তাপের ইঙ্গিত মিলছে। সম্প্রতি ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক ইকোনোমিক টাইমস এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ-ভারত গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি সংশোধনের চিন্তাভাবনা করছে ভারত। ২০২৬ সালে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই দেশটি এই চুক্তির শর্তাবলি পুনর্নির্ধারণ করতে চায়।

এই পরিস্থিতিকে ঘিরে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে পানির কূটনীতি আবারও কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের এই নতুন অবস্থান শুধু কৌশলগত নয়, বরং এক ধরনের চাপ প্রয়োগের কৌশলও হতে পারে।

গঙ্গা চুক্তির পটভূমি

১৯৯৬ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ.ডি. দেবগৌড়া ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় বহুল আলোচিত গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি। এই চুক্তির মাধ্যমে গঙ্গার পানি শুষ্ক মৌসুমে (জানুয়ারি থেকে মে) ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ভাগাভাগির একটি রূপরেখা নির্ধারিত হয়।

চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল ফরাক্কা বাঁধ এলাকায় পানির ন্যায্য প্রবাহ নিশ্চিত করা, যাতে করে বাংলাদেশে নদী নির্ভর কৃষি ও পরিবেশ রক্ষা সম্ভব হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ফরাক্কা পয়েন্টে প্রতি ১০ দিনের গড় প্রবাহ হিসাব করে উভয় দেশ পানির পরিমাণ নির্ধারণ করে। এতে গড় হিসাব অনুযায়ী ৩৫,০০০ কিউসেক পানি সরবরাহের নিশ্চয়তা ছিল।

ভারতের আপত্তি ও নতুন চাহিদা

ভারতের দাবি, বর্তমান চুক্তির শর্তাবলি তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচ এবং কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষার ক্ষেত্রে যথাযথ সেবা দিচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারও কেন্দ্রীয় সরকারের এই দাবিকে সমর্থন করছে বলে জানিয়েছে ইকোনোমিক টাইমস

ভারতের একাধিক সূত্র জানায়, তারা শুষ্ক মৌসুমে অতিরিক্ত ৩০,০০০ থেকে ৩৫,০০০ কিউসেক পানি নিজেদের ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করতে চায়। এর অর্থ, বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব কমে যেতে পারে—যা ঢাকা কর্তৃপক্ষের জন্য এক বড় উদ্বেগের কারণ।

ফরাক্কা বাঁধ এবং ঐতিহাসিক বিরোধ

ফরাক্কা বাঁধ, যা ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী নদীর ওপর নির্মিত এবং বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সীমান্ত থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, বরাবরই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার উৎস।

১৯৭৫ সালে ভারত একতরফাভাবে ফরাক্কা বাঁধ চালু করলে বাংলাদেশের বহু নদীতে পানির প্রবাহ কমে যায়, কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়। বহুবার অভিযোগ উঠেছে, ভারত গোপনে বেশি পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে, ফলে বাংলাদেশ তীব্র পানিসঙ্কটে পড়ছে।

নতুন চুক্তির প্রয়োজনীয়তা নাকি কৌশলগত চাপ?

ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, নতুন বাস্তবতায় পানি বণ্টন নীতিতে পরিবর্তন আনা জরুরি। তাদের যুক্তি, জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কৃষি-শিল্পে পানির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ৩০ বছর আগের করা চুক্তি বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই নয়।

কিন্তু বাংলাদেশি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি একটি রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে। সিন্ধু নদী চুক্তি স্থগিত করার মাধ্যমে পাকিস্তানের ওপর চাপ তৈরি করার পর এখন একইভাবে বাংলাদেশকে আলোচনার টেবিলে টেনে আনতেই এই পদক্ষেপ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, “ভারতের এমন আচরণ দক্ষিণ এশিয়ায় পানির নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক সম্পর্ককে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। গঙ্গার পানি শুধু একটি চুক্তির বিষয় নয়, এটি বাংলাদেশের লাখো মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে জড়িত।”

বাংলাদেশের অবস্থান ও প্রস্তুতি

বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত ভারতের প্রস্তাবের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, চুক্তির যেকোনো পরিবর্তনের বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে।

জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা এখনো ভারতের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাইনি। তবে বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আলোচনার প্রস্তুতিও রয়েছে।”

আঞ্চলিক রাজনীতি ও পানির ভবিষ্যৎ

বিশ্লেষকদের মতে, চীন, ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান—এই চার দেশের মধ্যে পানির উৎস, প্রবাহ ও চুক্তি নিয়ে সম্পর্ক দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। এমন প্রেক্ষাপটে ভারত যদি একতরফাভাবে চুক্তি সংশোধনের পথে এগোয়, তাহলে তা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার পানির কূটনীতি ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

পরিবেশবিদ এবং নদী গবেষক ড. মইনুল হক বলেন, “বাংলাদেশের মতো ভাটির দেশের জন্য পানির নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত যদি চুক্তির নামে পানি আটকে রাখার কৌশল নেয়, তবে কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও মানুষের জীবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

উপসংহার

গঙ্গা চুক্তি সংশোধনের প্রস্তাব নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে বাংলাদেশকে। একদিকে কূটনৈতিকভাবে আলোচনায় অংশ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা, অন্যদিকে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার অঙ্গীকার। আগামী দিনে দুই দেশের মধ্যে যেভাবে আলোচনা এগোয়, তা শুধু চুক্তির ভবিষ্যৎ নয়, দুই প্রতিবেশী দেশের পারস্পরিক আস্থার মাপকাঠিও হয়ে উঠবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button