আঞ্চলিক

৭ জেলায় একদিনে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ জন নিহত

সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশের প্রতিদিনের এক নির্মম বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যানবাহনের অপ্রশিক্ষিত চালক, বেপরোয়া গতি, নিয়ম না মানা ও পথচারীদের অসচেতনতা—সব মিলিয়ে দেশের সড়কগুলো যেন মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হয়েছে। এরই এক ভয়াবহ চিত্র দেখা গেল আজ শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫ তারিখে।

দেশের সাতটি জেলায় ঘটে যাওয়া পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ১৮ জন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১২ জন। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে ময়মনসিংহের ফুলপুরে, যেখানে বাস ও মাহেন্দ্র অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে একসঙ্গে প্রাণ গেছে ছয়জনের।

ময়মনসিংহে ভয়াবহ দুই দুর্ঘটনায় ৯ জন নিহত

ফুলপুরের দুর্ঘটনা:
শুক্রবার রাত আনুমানিক পৌনে ৯টার দিকে ময়মনসিংহ-হালুয়াঘাট সড়কের ফুলপুর পৌরসভার কুরিয়ার ব্রিজ এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাস ও মাহেন্দ্র অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান অটোরিকশার ছয়জন যাত্রী। স্থানীয়রা জানান, অটোরিকশাটি ফুলপুর থেকে কাশিনাথপুর যাচ্ছিল এবং তীব্র গতিতে আসা বাসটির সঙ্গে ধাক্কা লাগে। দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে স্থানীয়রা ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আহতদের উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান।

তারাকান্দার দুর্ঘটনা:
একই দিন বিকেলে ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার রামচন্দ্রপুর এলাকায় হিমালয় ফিলিং স্টেশনের সামনে একটি অ্যাম্বুলেন্স ও সিএনজি চালিত অটোরিকশার সংঘর্ষ ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান দুইজন এবং পরে হাসপাতালে নেয়ার পর আরও একজনের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও তিনজন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, অ্যাম্বুলেন্সটি একটি রোগী নিয়ে দ্রুতগতিতে হালুয়াঘাট যাচ্ছিল। সামনে থাকা অটোরিকশাকে পাশ কাটাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সংঘর্ষ ঘটে।

নাটোরে বাস-সিএনজি সংঘর্ষে প্রাণ গেল চারজনের

নাটোর সদর উপজেলার বনপাড়া এলাকায় যাত্রীবাহী বাস ও সিএনজির মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন চারজন। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন আরও দুইজন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সিএনজিটি নাটোর শহর থেকে বনপাড়া যাচ্ছিল। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি দ্রুতগতির বাস সিএনজিটিকে ধাক্কা দেয়। এতে সিএনজির সামনের অংশ দুমড়ে-মুচড়ে যায় এবং ঘটনাস্থলেই তিনজনের মৃত্যু হয়। আহতদের মধ্যে একজন নাটোর সদর হাসপাতালে মারা যান।

অন্যান্য জেলায় একাধিক প্রাণহানি

মানিকগঞ্জ:
সিঙ্গাইর উপজেলায় এক পথচারীকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায় একটি ট্রাক। নিহত ব্যক্তি স্থানীয় স্কুলশিক্ষক বলে জানা গেছে।

লালমনিরহাট:
পাটগ্রাম এলাকায় দ্রুতগতির একটি প্রাইভেটকারের ধাক্কায় এক বাইসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, দুর্ঘটনার সময় প্রাইভেটকার চালক মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন।

সিরাজগঞ্জ:
কাজিপুর উপজেলার বড়হর এলাকায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এক যুবকের মৃত্যু হয়। জানা যায়, তিনি হেলমেট না পরে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন এবং স্লিপ করে পড়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পান।

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে:
মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে সড়ক পার হওয়ার সময় দ্রুতগতির একটি প্রাইভেটকারের ধাক্কায় একজন বৃদ্ধ পথচারী নিহত হন।

জামালপুর:
জামালপুর সদরে একটি যাত্রীবাহী বাসের চাপায় এক রিকশাচালক নিহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রিকশাচালক সড়ক পার হচ্ছিলেন, এ সময় একটি বাস এসে ধাক্কা দেয়।

দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিক্রিয়া

বিভিন্ন দুর্ঘটনার প্রাথমিক কারণ হিসেবে উঠে এসেছে—চালকদের বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিং প্রতিযোগিতা, নিয়ম না মানা, রাস্তার বেহাল অবস্থা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “প্রতিদিনই আমরা এই ধরনের মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার খবর পাচ্ছি। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব, দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে যাতে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসে।”

পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে যে, প্রতিটি দুর্ঘটনার তদন্ত চলছে এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সমাধানের পথ কী?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো জরুরি:

  1. চালকদের প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স যাচাই:
    দক্ষ ও প্রশিক্ষিত চালকদেরই রাস্তায় চালানোর অনুমতি দিতে হবে।
  2. ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ:
    নিয়ম ভাঙলেই জরিমানা বা লাইসেন্স বাতিলের ব্যবস্থা নিতে হবে।
  3. সড়ক সংস্কার ও সাইনেজ বৃদ্ধি:
    বেহাল রাস্তা মেরামত করে নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করা জরুরি।
  4. সড়ক নিরাপত্তা সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন:
    স্কুল, কলেজ, গণমাধ্যমে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

উপসংহার

প্রতিদিনই সড়কে ঝরে যাচ্ছে মূল্যবান প্রাণ। দুর্ঘটনায় নিহত এসব মানুষদের পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া, যারা অনেকেই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ পেতে হলে আমাদের প্রয়োজন একটি সমন্বিত সড়ক নিরাপত্তা পরিকল্পনা এবং কার্যকর বাস্তবায়ন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সরকার, পরিবহন মালিক ও চালক সমিতি এবং সাধারণ জনগণের যৌথ উদ্যোগেই সম্ভব একটি নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button