
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্তাপ ও জাতীয় পুনর্গঠনের প্রেক্ষাপটে শহীদ আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধ ও অন্যান্যদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণা সংক্রান্ত বিষয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। সোমবার (১৪ জুলাই) বিচারপতি ফাহমিদা কাদেরের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ থেকে এ নির্দেশনা আসে, যা দেশে রাজনৈতিক ইতিহাস ও জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
হাইকোর্টের রুল কী বলছে?
আন্দোলনকালে শহীদ হওয়া আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধ, ওয়াসিমসহ অন্যান্যদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণার বিষয়ে হাইকোর্ট জানতে চেয়েছেন— কেন তাদের এ স্বীকৃতি দেওয়া হবে না। একই সঙ্গে আন্দোলনে শহীদদের একটি নির্ভরযোগ্য তালিকা তৈরি করে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কেন “জাতীয় সংস্কারক” ঘোষণা করা হবে না— সে বিষয়েও রুলে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
রুলের জবাব দিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন সচিব, তথ্য সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, প্রতিরক্ষা সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের চার সপ্তাহ সময় দিয়েছেন আদালত।
রিট আবেদনের পেছনের প্রেক্ষাপট
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য ইমদাদুল হক (হোয়াইট ম্যান) চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এ সংক্রান্ত রিট আবেদনটি দাখিল করেন। আবেদনকারীর পক্ষ থেকে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ইকরামুল কবির।
রিটে বলা হয়, ‘জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে’ যারা প্রাণ দিয়েছেন, তারা দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। অথচ এতদিনেও তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়নি। তাই তাদের জাতীয় বীর ঘোষণার মাধ্যমে প্রকৃত সম্মান দেওয়া সময়ের দাবি।
ড. ইউনূসকে “জাতীয় সংস্কারক” ঘোষণার প্রস্তাব
রিট আবেদনে অধ্যাপক ড. ইউনূসের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রিটের ভাষ্য অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, অর্থনীতি ও প্রশাসনিক কাঠামোতে নানা ধরনের সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছেন।
আইনজীবী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, “ড. ইউনূস ক্ষমতায় এসে বলেছেন, দেশটিকে নতুনভাবে গঠন করতে সংস্কারের পথে এগোবেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতে তাঁকে ‘জাতীয় সংস্কারক’ ঘোষণার প্রস্তাবও এই রিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।”
কোন আন্দোলনের শহীদ?
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের প্রতিবাদে বহু মানুষ শহীদ হন। আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধ এবং ওয়াসিম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আন্দোলনটি মূলত ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক উত্তরণের এক চূড়ান্ত ধাপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
তবে এখনো পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে এই শহীদদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, যা নিয়ে বিভিন্ন সময়েই সমালোচনা উঠে এসেছে নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে।
এই রুলের গুরুত্ব ও প্রতিক্রিয়া
নাগরিক সমাজের অনেকেই এই রুলকে স্বাগত জানিয়েছেন। মানবাধিকার কর্মী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “এই শহীদদের স্বীকৃতি শুধু ইতিহাসের প্রতি সম্মান নয়, এটি একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই রুল রাষ্ট্রীয় মর্যাদার প্রশ্নে নতুন বিতর্ক তৈরি করতে পারে। আবার অনেকেই মনে করেন, এই স্বীকৃতি দিলে জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে এবং ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝতে শিখবে।
আসন্ন সম্ভাবনা: কী হতে পারে এরপর?
এই রুলের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে তাদের মতামত আদালতে জমা দেবে। এরপর আদালত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন। যদি আদালতের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক হয়, তাহলে প্রথমবারের মতো গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে।
এ ছাড়া ড. ইউনূসকে “জাতীয় সংস্কারক” হিসেবে ঘোষণা করা হলে সেটিও হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম। এর মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক দর্শনের সূচনা হতে পারে।
“জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদরা এ দেশের গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত করতে রক্ত দিয়েছেন। তাদের জাতীয় বীরের মর্যাদা না দেওয়া ইতিহাসের প্রতি অন্যায়।” — আইনজীবী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ
সারসংক্ষেপ
হাইকোর্টের এই রুল শুধু একটি আইনি প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। শহীদদের সম্মান, গণতন্ত্রের চর্চা ও রাষ্ট্রীয় সংস্কারের প্রশ্নে এই রুল নতুন বিতর্ক ও আলোচনা উসকে দিচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত কী হবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
এম আর এম – ০৩৩২, Signalbd.com