ঢাকায় পৌঁছেছেন যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী জেনি চ্যাপম্যান। বৃহস্পতিবার সকালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তিনি। দুই দিনের এই সফরের মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ ও উন্নয়ন সহযোগিতামূলক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করা।
জেনি চ্যাপম্যানের সফরকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। কারণ, এটি এমন এক সময় ঘটছে, যখন বাংলাদেশে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে প্রশাসনিক কাঠামো নতুনভাবে গঠিত হচ্ছে এবং বিশ্ব সম্প্রদায় সেই পরিবর্তনের দিকে নিবিড়ভাবে দৃষ্টি রাখছে।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারের নতুন অধ্যায়
বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই দৃঢ়ভাবে গড়ে উঠেছে। ব্রিটেন প্রথম দিকের দেশগুলোর একটি যারা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি দিয়েছিল। এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, শিক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং মানবিক সহায়তার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বেড়ে চলেছে।
চ্যাপম্যানের সফর সেই সহযোগিতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে বলে আশা করছে কূটনৈতিক মহল।
ব্রিটিশ উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের (FCDO) এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে কাজ করে আসছে। তাদের অগ্রাধিকার হলো— দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষা, নারী উন্নয়ন, জলবায়ু অভিযোজন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়তা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক
সফরকালে জেনি চ্যাপম্যানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ। বৈঠকে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, অভিবাসন, মানবিক সহায়তা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চ্যাপম্যান বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় যুক্তরাজ্যের সহযোগিতা আরও সম্প্রসারণের বিষয়ে আগ্রহী। বিশেষ করে, টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের সুযোগ খোঁজা হবে।
রোহিঙ্গা সংকট ও কক্সবাজার সফর
চ্যাপম্যানের সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন। সেখানে তিনি যুক্তরাজ্য-সমর্থিত প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করবেন, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং নিরাপত্তা বিষয়ক উদ্যোগ।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমারে সেনা অভিযান থেকে পালিয়ে তারা কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। এই দীর্ঘমেয়াদি মানবিক সংকটে যুক্তরাজ্য শুরু থেকেই অন্যতম বৃহৎ আন্তর্জাতিক দাতা দেশ।
ব্রিটিশ সরকারের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় বছরে যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি সহায়তা দিয়েছে। এই অর্থের বড় অংশ ব্যয় হয়েছে খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ও নারীর সুরক্ষায়।
চ্যাপম্যান কক্সবাজার সফরে মাঠ পর্যায়ের কাজের অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জগুলো সরাসরি পর্যবেক্ষণ করবেন বলে জানা গেছে।
অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সহযোগিতা
সফরের সময় জেনি চ্যাপম্যান বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। আলোচনায় থাকবে বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ, কর সুবিধা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং ডিজিটাল অর্থনীতিতে যুক্তরাজ্যের সম্ভাব্য বিনিয়োগ।
যুক্তরাজ্য বর্তমানে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইউরোপীয় রপ্তানি গন্তব্য। তৈরি পোশাক, চামড়া, ওষুধ, আইটি ও কৃষিপণ্যসহ বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের রপ্তানি ক্রমেই বাড়ছে। অপরদিকে, যুক্তরাজ্যও বাংলাদেশে শিক্ষা, জ্বালানি, বন্দর উন্নয়ন এবং জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। ব্রিটিশ মন্ত্রী এই সহযোগিতাকে আরও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
জাতীয় নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সহযোগিতা
ঢাকায় অবস্থানকালে চ্যাপম্যানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হবে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের সঙ্গে। আলোচনায় সন্ত্রাস দমন, সাইবার নিরাপত্তা, মানব পাচার প্রতিরোধ এবং অভিবাসন সংক্রান্ত বিষয়গুলোর ওপর জোর দেওয়া হবে।
ব্রিটিশ সরকার দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং গোয়েন্দা সহযোগিতা দিয়ে আসছে। বিশেষ করে মানব পাচার ও অবৈধ অভিবাসন রোধে দুই দেশের মধ্যে তথ্য বিনিময় ও যৌথ কর্মপরিকল্পনা রয়েছে।
গোলটেবিল আলোচনা ও নীতিগত সংলাপ
জেনি চ্যাপম্যান ঢাকায় অবস্থানকালে “United Kingdom–Bangladesh Partnership Dialogue” শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেবেন। এতে সরকারি কর্মকর্তা, উন্নয়ন সংস্থা, অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদরা উপস্থিত থাকবেন।
আলোচনায় বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতি, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা পুনর্বিবেচনা করা হবে।
বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাজ্য কেবল একটি দাতা দেশ নয়, বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার। দেশটি শিক্ষা, বৃত্তি, গবেষণা ও কর্মসংস্থান ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তরুণদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করে আসছে।
বাংলাদেশে ব্রিটিশ সাহায্য ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর থেকেই যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের অন্যতম বড় উন্নয়ন সহযোগী। ব্রিটিশ কাউন্সিল, DFID (বর্তমানে FCDO), কমনওয়েলথ প্রোগ্রামসহ বিভিন্ন মাধ্যমে শিক্ষা, প্রশাসন ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গঠনে সহায়তা দিয়েছে দেশটি।
শুধু সরকারি পর্যায় নয়, ব্রিটিশ বাংলাদেশি প্রবাসীরাও দুই দেশের সম্পর্কের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে। বর্তমানে প্রায় ছয় লাখের বেশি ব্রিটিশ নাগরিকের শিকড় বাংলাদেশে, যারা যুক্তরাজ্যের রাজনীতি, ব্যবসা ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
চ্যাপম্যানের সফরের গুরুত্ব
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সফর যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও মানবিক প্রেক্ষাপট ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণের একটি অংশ। রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক সংস্কার—এই তিনটি বিষয় ব্রিটিশ নীতিনির্ধারকদের কাছে অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
এছাড়া, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থার প্রতীক হিসেবেও দেখা হচ্ছে এই সফরকে। যুক্তরাজ্য দীর্ঘদিন ধরে ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা ও দরিদ্র বিমোচন কার্যক্রমের প্রশংসা করে আসছে।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পথে। এ যাত্রায় যুক্তরাজ্যের প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা আরও প্রয়োজন হবে। ব্রিটিশ বিনিয়োগকারীরা ইতোমধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, টেক্সটাইল প্রযুক্তি ও শিক্ষা খাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
চ্যাপম্যানের এই সফর দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবে বলে আশা করছেন দুই দেশের নীতিনির্ধারকরা।
জেনি চ্যাপম্যানের এই সফর কেবল আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক পরিদর্শন নয়—এটি বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাজ্যের অঙ্গীকারের পুনঃপ্রতিশ্রুতি। দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, এবং মানবিক সহায়তার ঐতিহ্য ভবিষ্যতেও অটুট থাকবে বলে আশা করা যায়।
MAH – 13775 I Signalbd.com



