বাগরাম বিমানঘাঁটি: কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, কেন যুক্তরাষ্ট্র আবার তা ফিরে পেতে চায়

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাগরাম বিমানঘাঁটি দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও সামরিক কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ—সবকিছুতেই এই ঘাঁটির নাম উচ্চারিত হয়েছে বারবার। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলেছেন, তিনি চান বাগরাম আবার ওয়াশিংটনের নিয়ন্ত্রণে ফিরুক।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আসলে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এই ঘাঁটি? কেন ওয়াশিংটনের কাছে বাগরাম একটি বড় শক্তির প্রতীক? আর তালেবান কেন দৃঢ়ভাবে বলছে, আফগানিস্তানের মাটি কারও হাতে তুলে দেওয়া হবে না?
ট্রাম্পের দাবি: চীনকে ঠেকাতে বাগরাম চাই
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেন, আফগানিস্তানের বাগরাম ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র ফেরত পেতে চায়। তাঁর ভাষায়, “চীনকে মোকাবিলা করতে হলে এই ঘাঁটি আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা জরুরি।”
ট্রাম্প আরও এক ধাপ এগিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, “যদি যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বাগরাম ফিরিয়ে না দেওয়া হয়, তাহলে খারাপ কিছু ঘটবে।”
তবে আফগানিস্তানের তালেবান সরকার তাঁর এই দাবি নাকচ করে দিয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিফ অব স্টাফ ফাসিহউদ্দিন ফিতরাত বলেন, “আফগানিস্তানের এক ইঞ্চি মাটিও বিদেশিদের কাছে হস্তান্তর করা হবে না।”
বাগরামের ইতিহাস: সোভিয়েত থেকে মার্কিন দখল
বাগরামের ইতিহাস অর্ধশতকেরও বেশি পুরোনো।
- ১৯৫০–এর দশক: প্রথম এই ঘাঁটি নির্মাণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
- ১৯৮০–এর দশক: আফগান যুদ্ধে সোভিয়েত সেনাদের প্রধান ঘাঁটি হয়ে ওঠে বাগরাম।
- ২০০১ সাল: যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার পর আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু হয়। তালেবান পতনের পর বাগরাম চলে যায় মার্কিন নিয়ন্ত্রণে।
- ২০০২–২০২১ সাল: টানা দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র বাগরামকে তাদের আঞ্চলিক সামরিক কর্মকাণ্ডের মূল ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে।
এ সময়ে তিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট—জর্জ ডব্লিউ বুশ, বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্প—নিজেরা বাগরাম সফর করেছেন।
বাগরামের ভৌগোলিক অবস্থান
বাগরাম অবস্থিত পারওয়ান প্রদেশে, কাবুল থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তরে। এটির কৌশলগত অবস্থান এমন যে—
- পূর্বে পাকিস্তান,
- উত্তরে চীন,
- দক্ষিণে ভারত,
- পশ্চিমে ইরান ও মধ্য এশিয়া,
সবই এর নাগালে।
অর্থাৎ, এশিয়ার বড় শক্তিগুলোর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে চাইলে বাগরামের মতো ঘাঁটি প্রায় অমূল্য সম্পদ।
বাগরামের পরিকাঠামো ও সক্ষমতা
বাগরাম কেবল একটি বিমানঘাঁটি নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক কমপ্লেক্স।
- ৭৭ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত এলাকা।
- দুটি বৃহৎ রানওয়ে, যার একটি ৩.৬ কিলোমিটার লম্বা।
- বি–৫২ বোমারু বিমান, কার্গো প্লেনসহ যেকোনো ধরনের বিমান ওঠানামা করতে সক্ষম।
- আধুনিক জ্বালানি ডিপো, হাসপাতাল, হাজার হাজার সেনার আবাসন।
- বিশাল কমান্ড সেন্টার, যেখান থেকে গোটা অঞ্চলের সামরিক অভিযান পরিচালিত হতো।
- berপ্রসিদ্ধ কারাগার, যাকে বলা হতো “আফগানিস্তানের গুয়ানতানামো বে।”
সব মিলিয়ে এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক মিশনের স্নায়ুকেন্দ্র।
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থান
২০২০ সালে দোহা চুক্তির মাধ্যমে ট্রাম্প প্রথমবার সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। তাঁর উত্তরসূরি জো বাইডেন সেই চুক্তি বাস্তবায়ন করেন।
কিন্তু ২০২১ সালের আগস্টে তালেবানের দ্রুত অগ্রযাত্রার মুখে মার্কিন সেনারা তড়িঘড়ি করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। তখনই যুক্তরাষ্ট্র গোপনে বাগরাম ত্যাগ করে। এই ঘটনাকে অনেক বিশ্লেষক বলেন, “ওয়াশিংটনের জন্য অপমানজনক প্রস্থান।”
কেন এত গুরুত্বপূর্ণ বাগরাম?
১. চীনের ওপর নজরদারি
ট্রাম্পের ভাষায়, চীনের শিনজিয়াং অঞ্চল থেকে বাগরাম মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্বে। অর্থাৎ, চীনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে এটি একটি কৌশলগত সুবিধা দিতে পারে।
২. ইউরেশিয়ার কেন্দ্র
বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন কূটনীতিক জবিগনিউ ব্রেজিনস্কি ইউরেশিয়াকে “বিশ্ব রাজনীতির দাবার ছক” বলে বর্ণনা করেছিলেন। যে শক্তি ইউরেশিয়া নিয়ন্ত্রণ করবে, সেই শক্তি হবে বৈশ্বিক প্রভাবশালী। বাগরাম ঠিক সেই জায়গাতেই অবস্থিত।
৩. সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ
আল–কায়েদা, তালেবান ও আইএসের বিরুদ্ধে মার্কিন অভিযানে বাগরাম ছিল মূল কেন্দ্র। এখন এই ঘাঁটি না থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী সক্ষমতা অনেক কমে গেছে।
৪. খনিজ সম্পদের ওপর প্রভাব
আফগানিস্তান সমৃদ্ধ খনিজ সম্পদের ভান্ডার। বিরল মাটির খনিজ থেকে শুরু করে লিথিয়াম—সবকিছুতেই আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র। বাগরাম নিয়ন্ত্রণ মানে এই সম্পদগুলোর ওপর কৌশলগত প্রভাব বজায় রাখা।
৫. আঞ্চলিক বাণিজ্য রুট
আফগানিস্তান হয়ে নতুন বাণিজ্যিক করিডর ব্যবহার করতে চায় চীন ও রাশিয়া। বাগরাম নিয়ন্ত্রণে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র এই রুটগুলোতেও নজরদারি ও প্রভাব বিস্তার করতে পারবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
- চীন ও রাশিয়া: তারা চায় না যুক্তরাষ্ট্র আবার মধ্য এশিয়ায় শক্ত ঘাঁটি পাক। কারণ এটি তাদের প্রভাববলয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপের সমান।
- ইরান: বাগরাম ওয়াশিংটনের হাতে গেলে তাদেরও নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হবে।
- তালেবান সরকার: স্পষ্টভাবে বলেছে, “কোনো বিদেশি শক্তিকে আর এক ইঞ্চি জমি দেওয়া হবে না।”
- যুক্তরাষ্ট্র: ওয়াশিংটনের কৌশলগত চিন্তাবিদরা বলছেন, বাগরাম ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য এশিয়ায় কার্যক্রম পরিচালনা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে।
ট্রাম্পের লক্ষ্য কী?
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের মূল লক্ষ্য দুটি—
১. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি প্রদর্শন।
২. ২০২১ সালে যে “অপমানজনক প্রস্থান” হয়েছিল, সেটি মুছে ফেলা।
ট্রাম্প দেখাতে চান, যুক্তরাষ্ট্র এখনো মধ্য এশিয়া থেকে সরে যায়নি। বরং তারা ফিরে এসেছে আরও শক্তভাবে।
বাগরাম বিমানঘাঁটি শুধু একটি সামরিক ঘাঁটি নয়; এটি আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির প্রতীক। সোভিয়েত দখল থেকে শুরু করে মার্কিন উপস্থিতি, এরপর তালেবানের নিয়ন্ত্রণ—প্রতিটি অধ্যায়ই বাগরামের কৌশলগত গুরুত্ব প্রমাণ করেছে।
বর্তমানে ট্রাম্পের প্রচেষ্টা কেবল আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নয়; এটি আসলে চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াইয়ের অংশ।
তালেবান স্পষ্ট করে দিয়েছে, তারা কোনো বিদেশি শক্তিকে জায়গা দেবে না। কিন্তু ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা বলছে, বাগরাম নিয়ে এই টানাপোড়েন ভবিষ্যতেও আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনামে থাকবে।
MAH – 13039 I Signalbd.com