জাতীয়

পদত্যাগ প্রশ্নে মুখ খুললেন ড. ইউনূস, তবে বিদেশে নয়

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত রাজনৈতিক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন—তিনি কি পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন?

জাপান সফররত অবস্থায় জাপানি সংবাদমাধ্যম নিক্কেই এশিয়া এই প্রসঙ্গে তাঁর কাছে জানতে চাইলে, ড. ইউনূস কৌশলী উত্তর দেন। তিনি বলেন, “আমি বাংলাদেশেও এই প্রশ্নের উত্তর দিইনি। যেহেতু আমি বাংলাদেশে এটি বলিনি, যদি আমি জাপানে বলি, তাহলে আমার জন্য অনেক সমস্যা তৈরি হবে।”

এই বক্তব্যে স্পষ্ট, পদত্যাগ নিয়ে কোনো অবস্থান এখনই প্রকাশ করতে চান না তিনি। তবে এমন মন্তব্য ভবিষ্যতের রাজনীতিতে তার ভূমিকা এবং সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

পদত্যাগের গুঞ্জনের শুরু কোথা থেকে?

সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং নতুন গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (NCP) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দাবি করেন, ড. ইউনূস পদত্যাগ করতে পারেন—এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন এক ছাত্রনেতার সঙ্গে আলাপচারিতায়। তখন থেকেই রাজনীতির অন্দরমহলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে, দেশের সংলাপ ব্যর্থ হলে প্রধান উপদেষ্টা সরে দাঁড়াতে পারেন।

বিশ্লেষকদের মতে, ইউনূসের এই সম্ভাব্য পদত্যাগ দেশের অন্তর্বর্তী প্রক্রিয়াকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে এবং নতুন করে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।

“২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে”—সরাসরি অভিযোগ ক্ষমতাচ্যুত সরকারের বিরুদ্ধে

পদত্যাগের জল্পনা নিয়ে সরাসরি উত্তর না দিলেও, ড. ইউনূস সাক্ষাৎকারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করা হয়েছে।” তার দাবি অনুযায়ী, দেশেই আরও ১১-১২ বিলিয়ন ডলার পাচারের অর্থ চিহ্নিত হয়ে জব্দ করা হয়েছে।

এই পরিমাণ অর্থ পাচারের অভিযোগ যদি সত্য হয়, তবে তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্য একটি ভয়ানক ধাক্কা। বিশেষ করে যখন দেশ মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি এবং বাজেট ঘাটতি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, তখন এমন তথ্য জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

সার্বভৌম সম্পদ তহবিল গঠনের পরিকল্পনার কথা জানালেন

ড. ইউনূস আরও জানান, অন্তর্বর্তী সরকার জব্দকৃত অর্থের একটি বড় অংশ ব্যবহার করে দুটি ‘সার্বভৌম সম্পদ তহবিল’ (Sovereign Wealth Fund) গঠনের পরিকল্পনা করছে। এই তহবিলগুলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা হবে। পাশাপাশি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও তরুণদের উদ্যোক্তা হবার সুযোগ সৃষ্টি করাই হবে এই তহবিলের প্রধান লক্ষ্য।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এই পরিকল্পনা কার্যকর হয়, তাহলে এটি বাংলাদেশের উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে। তবে প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে—এই অর্থ কোথা থেকে এবং কীভাবে ফেরত আনা হবে?

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ড. ইউনূসের ভূমিকা ও সতর্কতা

জাপানে ড. ইউনূসের এই সাক্ষাৎকার শুধুমাত্র দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রশ্ন নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক মঞ্চেও বার্তা দিচ্ছে। একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করছেন, যাতে কোনো বিতর্ক বা সংকট তৈরি না হয়। তার বক্তব্য, “আমি দেশে কিছু বলিনি, বিদেশে বললে সমস্যা হবে”—এটি নিছক রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং একটি কূটনৈতিক সর্তকতা।

তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তিনি এখনো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টায় রয়েছেন—একদিকে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যস্থতা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা ও স্বচ্ছতা।

রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ: ইউনূস থাকছেন না সরে যাচ্ছেন?

ড. ইউনূসের এই বক্তব্য আরও একবার প্রমাণ করল, তিনি এখনো গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছেন এবং প্রতিটি বক্তব্য অত্যন্ত কৌশলে দিচ্ছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তার পদত্যাগ এখনই হলে অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে, যা দেশকে নতুন করে রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবে।

তবে যদি তিনি থেকে যান এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কার্যকর সংলাপ নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে হয়তো তার নেতৃত্বেই একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব হবে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ প্রসঙ্গে বিদেশে না বলার কৌশল, জাপানে দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং দেশের অর্থনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান দেশবাসীর মধ্যে নতুন আগ্রহ তৈরি করেছে। যদিও তিনি এখনও পর্যন্ত কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত জানাননি, তবে তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট, আগামী দিনগুলোতে তিনি কৌশলী অবস্থান অব্যাহত রাখবেন।

সামনের দিনগুলোতে সংলাপ ও রাজনৈতিক সমঝোতার অগ্রগতি দেখেই বোঝা যাবে, ড. ইউনূস পদত্যাগের পথে হাঁটবেন, না কি তিনি ‘পরিবর্তনের স্থপতি’ হিসেবে ইতিহাসে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করবেন।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button