জাতীয়

মার্চে সড়কে ঝরেছে ৬০৪ প্রাণ, মোটরসাইকেলেই ৪১ শতাংশের বেশি দুর্ঘটনা

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতা আরও একবার প্রমাণ করেছে বিদায়ী মার্চ মাস। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ মাসে দেশে মোট ৫৮৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৬০৪ জন মানুষ। আহত হয়েছেন অন্তত ১,২৩১ জন। মৃত্যুর মিছিলে রয়েছে ৮৯ জন নারী ও ৯৭ জন শিশু।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো—এই দুর্ঘটনার ৪১ দশমিক ২২ শতাংশ ঘটেছে মোটরসাইকেলের মাধ্যমে। অর্থাৎ সড়কে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় অর্ধেকের জন্য দায়ী দুই চাকার এই বাহনটি।

মোটরসাইকেলই সবচেয়ে বিপজ্জনক, নিহত ২৩৩ জন

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন বলছে, মার্চ মাসে শুধু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২৩৩ জনের প্রাণ গেছে। গত কয়েক বছরে মোটরসাইকেলের ব্যবহার যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে দুর্ঘটনার হারও। অধিকাংশ দুর্ঘটনাই ঘটছে গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, হেলমেট না পরা, ট্রাফিক আইন না মানা, এবং কিশোরদের বেপরোয়া চালনার কারণে।

থ্রি-হুইলারেও প্রাণহানি, নিহত ১১৯

মোটরসাইকেলের পর সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে থ্রি-হুইলার বা তিন চাকার যানবাহনে। ইজিবাইক, সিএনজি অটোরিকশা, অটোভ্যান ইত্যাদি যানবাহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১১৯ জন যাত্রী। গ্রামীণ ও মফস্বল এলাকায় এই যানবাহনের ওপর মানুষের নির্ভরতা যেমন বেশি, তেমনি চালকদের প্রশিক্ষণহীনতা এবং রাস্তায় তাদের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল প্রাণহানির অন্যতম কারণ।

আঞ্চলিক সড়কই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ

প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্চ মাসে ঘটিত দুর্ঘটনার মধ্যে ৪৩ দশমিক ৬১ শতাংশই ঘটেছে আঞ্চলিক সড়কে। এসব সড়কে তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নেই, নেই আলাদা লেন বা পর্যাপ্ত সাইনেজ। ফলে এগুলো হয়ে উঠেছে মৃত্যুফাঁদ।

নিয়ন্ত্রণ হারানোই প্রধান কারণ

সড়ক দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ হারানো। অতিরিক্ত গতি, অপ্রশিক্ষিত চালক, দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানোয় চালকের ঘুমিয়ে পড়া, হঠাৎ বাঁক নেওয়া ইত্যাদি কারণে দুর্ঘটনার হার বেশি বলে জানানো হয় প্রতিবেদনে।

ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ দুর্ঘটনা, সিলেটে সবচেয়ে কম

বিভাগওয়ারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যেখানে যানবাহনের ঘনত্ব এবং মানুষের চলাচল সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে তুলনামূলক কম জনবহুল সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে কম।

বগুড়ায় সর্বোচ্চ প্রাণহানি, নেত্রকোনায় প্রাণহানি শূন্য

জেলার হিসেবে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ছিল বগুড়ায়। সেখানে ২৭টি দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৩২ জনের। বিপরীতে নেত্রকোনায় কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটলেও সেখানে কোনো প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি, যা একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত।

রাজধানী ঢাকাতেও উদ্বেগজনক অবস্থা

রাজধানী ঢাকায় মার্চ মাসে ২১টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৪ জন এবং আহত হয়েছেন অন্তত ৫৩ জন। গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত গাড়ির অনিয়ন্ত্রিত চলাচল, ফুটপাত দখল, সঠিক জেব্রা ক্রসিং না থাকা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাই এই শহরের সড়ক বিপর্যয়ের মূল কারণ।

সবচেয়ে বেশি নিহত শিক্ষার্থী

প্রতিবেদনে সবচেয়ে বেদনাদায়ক তথ্য হলো—মার্চ মাসে নিহতদের মধ্যে ৭২ জন শিক্ষার্থী ছিলেন। এদের মধ্যে অনেকেই স্কুল, কলেজ ও কোচিং সেন্টারে যাতায়াতের পথে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। শিশু ও কিশোর বয়সীদের মধ্যে সড়কে নিরাপদে চলাচলের বিষয়ে সচেতনতার ঘাটতি ও অভিভাবকহীনতা এর পেছনে বড় কারণ।

নারী ও শিশু মৃত্যুও উদ্বেগজনক

মোট ৮৯ জন নারী এবং ৯৭ জন শিশু মার্চ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই নারী ও শিশু যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়ে চালক ও সহকারীদের অসচেতনতা এবং যানবাহনের কাঠামোগত দুর্বলতা এই হতাহতের জন্য দায়ী।

নৌ ও রেলপথেও দুর্ঘটনা

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে শুধু সড়ক নয়, নৌ ও রেলপথের দুর্ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে। মার্চ মাসে ৬টি নৌ দুর্ঘটনায় ৯ জন নিহত এবং ১৪ জন আহত হয়েছেন। একই সময়ে ১৬টি রেল দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ১৯ জনের এবং আহত হয়েছেন আরও ৪ জন। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রায় প্রতিটি খাতেই নিরাপত্তার ঘাটতি প্রকট হয়ে উঠছে।

বিশ্লেষণ: কীভাবে থামবে এই মৃত্যুর মিছিল?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যেসব সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে চিহ্নিত—যেমন দুর্বল নিয়ন্ত্রণ, অনিরাপদ যান, অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, দুর্বল আইন প্রয়োগ—তা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ঘাটতি রয়েছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন একাধিকবার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার, চালকদের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স প্রক্রিয়া কঠোর করার সুপারিশ করেছে।

সড়কে শিক্ষার্থী, শিশু ও নারীদের মৃত্যুহার বাড়ায় সমাজে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হচ্ছে, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পরিবার ও অর্থনীতির ওপরও পড়ছে।

করণীয়: সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতে যে পদক্ষেপ দরকার

  1. প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও লাইসেন্সধারী চালক নিশ্চিত করা
  2. মোটরসাইকেল আরোহীদের জন্য বাধ্যতামূলক হেলমেট আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ
  3. ইজিবাইক ও থ্রি-হুইলার চলাচলে সুনির্দিষ্ট রুট নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ
  4. আঞ্চলিক সড়কে নজরদারি ও টহল বাড়ানো
  5. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ট্রাফিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালু
  6. নিরাপদ পথচারী ক্রসিং, ওভারব্রিজ ও ফুটপাত তৈরি ও বজায় রাখা
  7. ট্রাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ ও মোবাইল কোর্টের কার্যকর ব্যবহার
মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button