বিডিআর হত্যা তদন্তে নতুন তথ্য: সেনা কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেল কমিশন
ঢাকার পিলখানায় ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির ভয়াবহ বিডিআর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশ ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। ওই ঘটনার ১৬ বছর পর জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন তাদের নতুন প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে একাধিক চাঞ্চল্যকর তথ্য। কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী, পিলখানা ট্র্যাজেডির আগের দিন ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় গোপনে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সেই গোপন বৈঠক, নির্দেশনা, অস্ত্র নেওয়ার পরিকল্পনা এবং সেনা কর্মকর্তাদের ভূমিকা সম্পর্কে এবার উঠে এসেছে নতুন তথ্য।
কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনের ১৪ নম্বর কারাবন্দীর সাক্ষ্যে বলা হয়, সিপাহী মইনুদ্দিন, সিপাহী সেলিমসহ ১০-১২ জন জওয়ান ২৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের মাঠে বৈঠকে বসেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, দরবার অনুষ্ঠানের সময় সেনা কর্মকর্তাদের জিম্মি করার জন্য তারা রশি ও চাকু সঙ্গে রাখবেন। কারণ কর্মকর্তারা প্রতিরোধ করতে চাইলে তা দমন করতে হবে—এই পরিকল্পনাই ছিল তাদের আলোচনার মূল বিষয়।
লে. কর্নেল শামসের ডাক ও নির্দেশনা
১৪ নম্বর সাক্ষী আরও জানিয়েছেন যে, ওই রাতেই লে. কর্নেল শামস সিপাহী সেলিম এবং সিপাহী মইনুদ্দিনকে ব্যক্তিগতভাবে ডাকেন। তিনি তাদের বলেন—
“আগামীকাল কোয়ার্টার গার্ডে মেজর রিয়াজ ডিউটিতে থাকবে। তোমরা গেলে সে তোমাদের অস্ত্র দিয়ে দেবে।”
এই বক্তব্যের পর তদন্ত কমিশনের সদস্যরা আরও গভীরভাবে অনুসন্ধানে নামেন। প্রশ্ন উঠে—কেন একজন উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা জুনিয়র সৈনিকদের ‘অস্ত্র দেওয়ার’ কথা বলবেন? এই পরিকল্পনার সঙ্গে তার কী ধরনের যোগসূত্র ছিল?
জুয়েলকে ফোনে নির্দেশনা – কমিশনের প্রতিবেদনেই উঠে এল আরেক চাঞ্চল্য
সাক্ষীদের জবানবন্দি অনুযায়ী, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের আগ মুহূর্তে একাধিক মোবাইল কথোপকথন ঘটে, যা পরে তদন্তকারীদের হাতে আসে। এসব কথোপকথনের মধ্যে রয়েছে তাপস নামের এক সদস্যের নির্দেশনা। প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে যে তাপস নিয়মিত নামাজ শেষে কয়েকজন সৈনিককে নিয়ে গোপন বৈঠকে বসতেন এবং বিদ্রোহের প্রস্তুতি সম্পর্কে আলোচনা করতেন।
তদন্ত কমিশন বলছে, তাপসের কথাবার্তার ধরন ও তার দেওয়া নির্দেশনার সঙ্গে সামগ্রিক বিদ্রোহ পরিকল্পনার সরাসরি মিল রয়েছে। তিনি কয়েকজন সৈনিককে নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে অবস্থান নিতে বলেন। কমিশনের বিশ্লেষণে দেখা যায়, তাপস ছিলেন বিদ্রোহের সক্রিয় পরিকল্পনাকারীদের একজন।
৬৫ নম্বর সাক্ষীর জবানবন্দি: সেন্ট্রাল কোয়ার্টার গার্ডেই ছিল তিন ব্যাটালিয়নের অস্ত্র
৬৫ নম্বর সাক্ষী জানান যে, সেন্ট্রাল কোয়ার্টার গার্ডে তখন তিনটি ব্যাটালিয়নের (২৪, ৪৪ এবং সদর ব্যাটালিয়ন) অস্ত্র মজুদ ছিল। এর ফলেই বিদ্রোহীরা দ্রুত অস্ত্র দখল করতে সক্ষম হয়। তিনি জানান—ঘটনার কয়েক দিন আগে থেকেই সেনা কর্মকর্তারা বাড়তি সতর্কতা হিসেবে কোয়ার্টার গার্ডে ডিউটি দিচ্ছিলেন।
২১ ফেব্রুয়ারি থেকেই ওই ডিউটি শুরু হয়। সাক্ষী বলছেন, এ বিষয়ে মেজর রিয়াজ যখন জিএসও-২ মেজর মাহমুদকে প্রশ্ন করেন, তিনি জানান—
“একটি উড়ো চিঠির কারণে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে।”
এর বেশি কিছু তিনি জানাননি।
এই চিঠি সম্পর্কে তদন্ত কমিশন এখনও নির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ করেনি। তবে তারা বলছে, ওই চিঠি হয়তো ভেতরের কেউ ইচ্ছাকৃতভাবেই ছড়িয়েছিল, যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ভূমিকা তৈরি হয়।
‘বিডিআর বিদ্রোহ’: ইতিহাসের কালো অধ্যায়
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিদ্রোহী জওয়ানরা তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর সদর দপ্তরে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড চালায়। ওই ঘটনায় ৫৭ জন মেধাবী ও অভিজ্ঞ সেনা কর্মকর্তা নির্মমভাবে নিহত হন। এই হত্যাযজ্ঞ শুধু বাংলাদেশকেই স্তব্ধ করে দেয়নি, আন্তর্জাতিক মহলেও নেমে আসে উদ্বেগ।
সময়ের পরিক্রমায় বিডিআর-এর নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) করা হয়। প্রতিষ্ঠানকে পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে স্থিতিশীল করা হয়। তবে সেই ভয়াবহ ঘটনার ক্ষত আজও বয়ে বেড়ান নিহত সেনা সদস্যদের পরিবার, সহকর্মী এবং দেশবাসী।
১৬ বছর পর নতুন তদন্ত—কেন আবার আলোচনায় পিলখানা?
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন ঘটনাটির পটভূমি, পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য এবং ভেতরের-বাইরের জড়িতদের সম্পূর্ণ চিত্র নতুনভাবে অনুসন্ধান করছে। আগের তদন্তগুলোতে অনেক প্রশ্ন অজানা রয়ে গেছে, অনেক নাম তদন্তের আওতার বাইরে ছিল। ফলে পরিবারগুলো বারবার দাবি জানিয়েছিল নতুন স্বাধীন অনুসন্ধানের।
কমিশন বলছে, আগের তদন্তে কিছু তথ্যে ঘাটতি ছিল, সেই ঘাটতি পূরণ করতেই তারা আবার সাক্ষী ও প্রমাণ সংগ্রহ করছে।
সেনা কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
নতুন প্রতিবেদনে কমিশন জানিয়েছে, কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার আচরণ, নির্দেশনা এবং আগের দিনের বৈঠকে তাদের উপস্থিতি সন্দেহজনক।
তারা বলছে—বিদ্রোহের আগের রাত থেকে কয়েকজন কর্মকর্তা অস্বাভাবিকভাবে কিছু জওয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। বিশেষ করে—
১. অস্ত্র দেওয়ার নির্দেশনা
যেকোনো সামরিক স্থাপনায় অস্ত্র সংগ্রহ অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়া। সেখানে একজন কর্মকর্তা যদি জুনিয়র সদস্যদের ‘অস্ত্র দেওয়ার’ কথা বলেন, সেটি তদন্তের বিষয়।
২. উড়ো চিঠি নিয়ে ধোঁয়াশা
উড়ো চিঠির ভিত্তিতে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হলেও সেই চিঠির উৎস সম্পর্কে কেউ স্পষ্ট তথ্য দিতে পারেননি। এতে সন্দেহ আরও গভীর হয়েছে।
৩. গোপন বৈঠকে কর্মকর্তার উপস্থিতি
সাক্ষীরা বলছে, কিছু বৈঠক হয়েছিল যেখানে কর্মকর্তাদের দেখা গেছে। এসব ঘটনার ভিডিও/অডিও প্রমাণ কমিশনের হাতে এলেও তা অফিসিয়ালি প্রকাশ করা হয়নি।
পিলখানা হত্যাকাণ্ড: পরিকল্পনা নাকি হঠাৎ ঘটনার বিস্ফোরণ?
বিগত সরকারগুলোর বক্তব্য ছিল—ঘটনাটি মূলত বেতন-বৈষম্য, রেশন, মিশনের সুযোগ প্রভৃতি ইস্যুতে ক্ষোভ থেকে ‘হঠাৎ’ সংঘটিত হয়। কিন্তু নতুন তদন্ত বলছে, ঘটনাটি হঠাৎ নয়; বরং কয়েক সপ্তাহ ধরে পরিকল্পনা করা এক বৃহৎ নাশকতার অংশ।
নতুন সাক্ষ্যগুলোতে উঠে এসেছে—
- কিছু জওয়ান বহুদিন ধরেই ক্ষোভ ও বিদ্রোহী মনোভাবের ইন্ধন দিচ্ছিল
- গোপন বৈঠক, ফোনালাপ ও অস্ত্র পরিকল্পনা আগেই করা হয়েছিল
- দরবার অনুষ্ঠানে হঠাৎ হামলার সিদ্ধান্ত ছিল
- সেনা কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট টার্গেট বানানো হয়
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতামত: ‘ঘটনার পুনরায় তদন্ত জরুরি ছিল’
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বহু বছর ধরেই বলছিলেন—আগের তদন্তে কিছু বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে। বিশেষ করে বাহিনীর ভেতরের-বাইরের কারা এই বিদ্রোহের পরিকল্পনাকারী ছিল সে বিষয়ে স্পষ্টতা পাওয়া যায়নি। তাই জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তারা।
একজন বিশ্লেষক বলেন—
“পিলখানা হত্যা শুধু বিদ্রোহ নয়, এটি ছিল দেশের সামরিক কাঠামো ভেঙে দেওয়ার অপচেষ্টা। কারা এর পেছনে ছিল তা পরিষ্কার হওয়া জরুরি।”
নিহত সেনা সদস্যদের পরিবার: ‘আমরা সত্য জানতে চাই’
বিগত ১৬ বছর ধরে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারগুলো সত্য উদঘাটনের দাবি জানিয়ে আসছে। অনেকেই বলেছেন —
“আমরা বিচার পেয়েছি, কিন্তু সত্যের পুরোটা পাইনি।”
নতুন কমিশন তদন্ত শুরু করার পর পরিবারগুলো বলছে—
- আসল পরিকল্পনাকারীরা কারা ছিলেন
- বাহিনীর ভেতরের কোন অংশের লোকেরা সাহায্য করেছিলেন
- কেন দরবারের দিনই হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল
এসব প্রশ্নের উত্তর তারা জানতে চান।
কমিশনের পরবর্তী পদক্ষেপ
কমিশন জানিয়েছে—
- আরও ১২৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে
- নতুন প্রযুক্তিতে পুরোনো অডিও-ভিডিও আবার বিশ্লেষণ করা হচ্ছে
- ফোন কল ডেটার পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ চলছে
- সামরিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে আচরণগত বিশ্লেষণ করানো হয়েছে
তাদের মতে, এ রিপোর্ট পুরো জাতির কাছে প্রকাশ করতে হবে যাতে ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায় স্বচ্ছতার মাধ্যমে সামনে আসে।
পিলখানা হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অপরিমেয় ক্ষতি। তদন্ত কমিশনের নতুন প্রতিবেদন সেই কলঙ্কজনক ঘটনার নতুন পর্দা উন্মোচন করেছে। কোন সেনা কর্মকর্তা কী ভূমিকা রেখেছিলেন, কারা নির্দেশনা দিয়েছিলেন, কারা পরিকল্পনার ভেতরের মানুষ ছিলেন — এসব প্রশ্নের উত্তর সামনে আসছে ধাপে ধাপে।
১৬ বছর পর আবারো আলোচনায় আসা পিলখানা ট্র্যাজেডি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
সত্য চাপা পড়ে থাকতে পারে, কিন্তু হারিয়ে যায় না।
MAH – 14091 I Signalbd.com



