জাতীয়

অগ্নিদুর্ঘটনা এড়াতে দেশজুড়ে ভূমি অফিসগুলোর নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ

Advertisement

দেশজুড়ে ভূমি অফিসগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি দেশে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নথি ও রেকর্ড পুড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ভূমি মন্ত্রণালয় মাঠ পর্যায়ের সব ভূমি অফিসে অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছে।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের জরুরি নির্দেশনা

গত সোমবার (২০ অক্টোবর) ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন-২ শাখা থেকে সব জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়— সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হঠাৎ করে একাধিক অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে, যা সরকারি সম্পদ ও রেকর্ডের জন্য হুমকিস্বরূপ।

চিঠিতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে—

  • জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রেকর্ডরুমে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন,
  • উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র স্থাপন,
  • বিদ্যুৎ সংযোগ ও নিরাপত্তা পরিদর্শন নিয়মিত করা,
  • এবং অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি এড়াতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা

ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. খলিলুর রহমান সই করা ওই নির্দেশনায় বলা হয়,

“ভূমি রেকর্ড ও সংরক্ষিত নথিপত্র রাষ্ট্রের অমূল্য সম্পদ। তাই যে কোনো দুর্ঘটনা বা অগ্নিকাণ্ড থেকে এসব রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি।”

কেন এমন নির্দেশনা এখন জরুরি?

বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে প্রশাসনিক ভবন ও সরকারি দপ্তরে একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অনেক সময় এসব দুর্ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, খতিয়ান, রেকর্ড বই ও জমি সংক্রান্ত প্রমাণ পুড়ে গেছে, যা পরবর্তীতে নাগরিক ভোগান্তির কারণ হয়েছে।

সাম্প্রতিক কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্নিকাণ্ড:

  • ২০২৪ সালের জুনে কুমিল্লা জেলা ভূমি অফিসে আগুন, যেখানে বহু পুরনো রেকর্ড নষ্ট হয়।
  • ২০২৩ সালে নারায়ণগঞ্জ ভূমি রেকর্ড অফিসে অগ্নিকাণ্ড, ক্ষতিগ্রস্ত হয় শতাধিক জমি নথি।
  • ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা ভূমি অফিসে আগুন, যা বিদ্যুৎ সংযোগজনিত শর্ট সার্কিট থেকে সূত্রপাত হয়েছিল বলে জানা যায়।

এই ঘটনাগুলো সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ফলে বর্তমান নির্দেশনা শুধুমাত্র সতর্কতা নয়, বরং একটি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার পরিকল্পনার অংশ হিসেবেও দেখা হচ্ছে।

কোন কোন দপ্তর নির্দেশনার আওতায়?

ভূমি মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনা শুধু জেলা প্রশাসন নয়, বরং দেশের সকল স্তরের ভূমি প্রশাসন কাঠামোকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
নির্দেশনা অনুযায়ী নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে—

  • জেলা প্রশাসকের কার্যালয়,
  • উপজেলা ভূমি অফিস,
  • রাজস্ব সার্কেল অফিস,
  • ইউনিয়ন ভূমি অফিস,
  • এবং মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে।

এছাড়া, সব বিভাগীয় কমিশনার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর কাছেও নির্দেশনার অনুলিপি পাঠানো হয়েছে, যাতে স্থানীয় পর্যায়ে তদারকি নিশ্চিত হয়।

সরকারের লক্ষ্য: ডিজিটাল ও নিরাপদ ভূমি ব্যবস্থাপনা

ভূমি মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, দেশের ভূমি প্রশাসনকে পুরোপুরি ডিজিটাল ও নিরাপদ করার জন্য ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।
বিশেষত “ডিজিটাল ভূমি সেবা (DLRS)” প্রকল্পের আওতায় জমির রেকর্ড সংরক্ষণ, নামজারি ও খতিয়ান অনলাইনে দেখার সুবিধা চালু হয়েছে।

তবে এখনো বহু পুরনো নথি কাগজে সংরক্ষিত রয়েছে, যেগুলোতে আগুন বা প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে যায়। তাই অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হচ্ছে “ডিজিটাল রূপান্তর সুরক্ষা ব্যবস্থার” একটি অংশ হিসেবে।

একজন ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলেন,

“পুরনো রেকর্ডগুলো ডিজিটাইজ করার কাজ চলছে, কিন্তু সবকিছু অনলাইনে না যাওয়া পর্যন্ত আমাদেরকে ফিজিক্যাল নথিপত্রের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আগুনের ঘটনা প্রতিরোধ এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

সিসিটিভি ও ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে

ভূমি অফিসগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিতের অংশ হিসেবে সিসিটিভি ক্যামেরা, ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম, ধোঁয়া শনাক্তকরণ যন্ত্র এবং অগ্নি নির্বাপক সিলিন্ডার স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর জানিয়েছে,
ভূমি অফিসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদের পক্ষ থেকেও ঝুঁকি নিরূপণ (Fire Risk Assessment) কার্যক্রম শুরু করা হবে।

একজন ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা জানান,

“ভূমি অফিসে প্রচুর কাগজ, কাঠের আসবাব, পুরনো ফাইল ও বৈদ্যুতিক সংযোগ থাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি অনেক বেশি। তাই প্রতিটি অফিসে নিরাপত্তা মানদণ্ড মেনে চলা অপরিহার্য।”

মাঠ প্রশাসনের ভূমিকা

জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) ভূমিকা এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে—

  • প্রতিটি ভূমি অফিসে নিরাপত্তা মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করতে,
  • ফায়ার ড্রিল বা মক ফায়ার এক্সারসাইজ আয়োজন করতে,
  • এবং কর্মীদের অগ্নি নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে।

বেশ কিছু জেলা প্রশাসক ইতোমধ্যেই মাঠে কাজ শুরু করেছেন।
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক বলেন,

“আমরা প্রতিটি ভূমি অফিসে সিসিটিভি, ফায়ার অ্যালার্ম ও জরুরি নির্গমন ব্যবস্থা চালু করছি। এ ছাড়া বিদ্যুৎ ব্যবস্থার তদারকি দলও গঠন করা হয়েছে।”

অবকাঠামোগত উন্নয়নেও জোর

ভূমি অফিসের বেশিরভাগ ভবন পুরনো, অনেক জায়গায় ভবনগুলো নির্মাণ হয়েছে ৩০-৪০ বছর আগে। তাই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেসব ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই, সেখানে নতুন বিল্ডিং কোড অনুযায়ী সংস্কার বা পুনর্নির্মাণ করা হবে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় নতুন অগ্নি প্রতিরোধী (Fire-resistant) ডিজাইনে ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

নিরাপত্তা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের এই উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদে ভূমি প্রশাসনকে সুরক্ষিত ও আধুনিক করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ফারুক আহমেদ বলেন,

“সরকারি রেকর্ড নষ্ট হয়ে গেলে শুধু রাষ্ট্র নয়, নাগরিকরাও ভোগান্তিতে পড়েন। তাই অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে ডিজিটাল ব্যাকআপ সিস্টেমও সমানভাবে শক্তিশালী করতে হবে।”

নাগরিক প্রত্যাশা

জনগণের প্রত্যাশা, এই নির্দেশনা শুধু কাগজে না থেকে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়িত হোক।
বেশ কিছু নাগরিকের অভিমত— ভূমি অফিসে আগুন লাগলে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ তারা তাদের জমির প্রমাণ হারান। তাই সরকার যদি নিয়মিত তদারকি করে, তাহলে ভবিষ্যতে এমন ক্ষতি অনেকটাই রোধ করা সম্ভব হবে।

অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে ভূমি অফিসে নিরাপত্তা জোরদারের সরকারি নির্দেশনা কেবল প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, এটি দেশের ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থার ভিত্তি রক্ষার উদ্যোগ
যদি এই নির্দেশনা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে সরকারি রেকর্ডের নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি নাগরিক আস্থা আরও বাড়বে।

সংক্ষেপে মূল পয়েন্টসমূহ:

  • সব জেলা ও উপজেলা ভূমি অফিসে অগ্নি নিরাপত্তা জোরদার নির্দেশ
  • রেকর্ডরুমে সিসিটিভি ক্যামেরা ও ফায়ার অ্যালার্ম স্থাপন বাধ্যতামূলক
  • পুরনো ভবনে অগ্নি প্রতিরোধী ব্যবস্থা সংযোজনের পরিকল্পনা
  • ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতায় ঝুঁকি মূল্যায়ন ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম
  • ডিজিটাল রেকর্ড সুরক্ষায় সমন্বিত পদক্ষেপ

MAH – 13434 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button