ফ্যাক্ট চেক

আশুরার রোজা রাখার সঠিক নিয়ম ও তাৎপর্য

Advertisement

আশুরার রোজা: ইসলামিক ঐতিহ্যের এক অনন্য অংশ

পবিত্র মহররম মাসের দশ তারিখে পালিত হয় আশুরা দিবস, যা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও তাৎপর্যময় একটি দিন। আশুরা শব্দটি আরবি “আশারা” থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘দশ’। আরবি সনের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখকেই পবিত্র আশুরা বলা হয়। এই দিনটির ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অত্যন্ত বিশাল, কারণ এদিন মহান আল্লাহ তাআলা প্রথম আকাশ, বাতাস, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, জান্নাত-জাহান্নাম এবং যাবতীয় সৃষ্টি-জীবের আত্মার সৃষ্টির আদেশ দেন।

এত গুণী গুণের কারণে, আশুরার রোজা রাখা মুসলিম উম্মাহর জন্য বিশেষ ধর্মীয় কর্তব্য এবং সওয়াবের অন্যতম উৎস।

নবীজির (সা.) আদর্শ: আশুরার রোজার সূত্রপাত ও নিয়ম

মুফতি জাকারিয়া হারুনসহ ইসলামের বিশিষ্ট পণ্ডিতগণ বর্ণনা করেন, নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদিনায় হিজরত করার পর একবার মদিনার ইহুদি সম্প্রদায়কে আশুরার দিন রোজা রাখতে দেখেন। নবীজির প্রশ্নে তারা জানান, এই দিনে মহান আল্লাহ মুসা (আঃ) ও তার অনুসারীদের ফিরাউন ও তার বাহিনী থেকে মুক্তি দিয়েছেন। সেই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মুসা (আঃ) এই দিন রোজা রাখতেন, আর তারা তাঁর পথ অনুসরণ করে রোজা পালন করে।

নবীজি (সা.) ইহুদিদের এই রোজার কারণ শুনে বললেন, “আমরা তো তাদের চেয়ে অধিক যত্নবান।” এরপর তিনি নিজে আশুরার রোজা রাখলেন এবং মুসলমানদেরও তা পালন করার নির্দেশ দিলেন। (সূত্র: বুখারি: ৩৩৯৭; মুসলিম: ১১৩৯)

আশুরার রোজার দুই দিন রাখা কেন জরুরি?

আশুরার রোজার সঙ্গে সংযুক্ত একটি বিশেষ নিয়ম হলো, শুধুমাত্র দশ তারিখের রোজা রাখা যথেষ্ট নয়। নবীজির (সা.) এক নির্দেশনা অনুযায়ী, আশুরার ১০ তারিখের সঙ্গে মিল রেখে ৯ তারিখ অথবা ১১ তারিখেও রোজা রাখা উত্তম, যাতে ইহুদিদের রোজার সাথে মিল না পড়ে এবং আলাদা পরিচয় বজায় থাকে।

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, যখন সাহাবারা নবীজিকে (সা.) বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, বিধর্মীরা তো এই দিনটিকে বড়দিন মনে করে রোজা রাখে। আমরা যদি একই দিন রোজা রাখি, তাহলে আমাদের সঙ্গে তাদের মিল হবে।” জবাবে নবীজী (সা.) বলেন, “তারা যেমন একদিন রোজা রাখে, আমরা দুইদিন রাখব, ইনশাআল্লাহ।” (মুসলিম: ১১৩৪)

তাই আশুরার রোজা মোট দুই দিন পালন করা হয়—একটি মহররমের ১০ তারিখে, আরেকটি ৯ বা ১১ তারিখে।

আশুরার রোজা রাখার সঠিক পদ্ধতি

১. মহররম ৯ এবং ১০ তারিখে রোজা রাখা: নবীজির নির্দেশ অনুসারে প্রথমে ৯ তারিখে রোজা রাখা উচিত, পরের দিন ১০ তারিখেও রোজা রাখা হয়। তবে কেউ ইচ্ছা করলে ১০ এবং ১১ তারিখেও রোজা রাখতে পারেন।

২. দুটি রোজার মধ্য থেকে যে কোন একদিন থেকে শুরু করা যাবে: অর্থাৎ ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখের যেকোনো দুদিন রোজা রাখা যাবে।

৩. দুপুরের সময় কেবল পানাহার এড়াতে হবে: রোজাদারের জন্য যথাযথ ভোজ-বিভোজন এড়িয়ে সিয়াম পালন করাই আবশ্যক।

আশুরার রোজার গুরুত্ব ও সওয়াব

আশুরার রোজা ইসলামে অত্যন্ত বরকতময়। নবীজির (সা.) নিজে এই রোজা পালন করেছেন এবং উম্মতকে এর প্রতি অনুপ্রাণিত করেছেন। এই রোজা মূলত আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং অতীত নবীদের নিদর্শন অনুসরণের এক মহান উদাহরণ।

মুসলিম উম্মাহর জন্য এটি এমন এক সুযোগ, যার মাধ্যমে তারা তাদের পুণ্য বৃদ্ধি করতে পারে এবং আল্লাহর কাছ থেকে বিশেষ রহমত ও মাগফিরাত লাভ করতে পারে।

আশুরার পবিত্রতা ও ইতিহাসের পটভূমি

আশুরার দিনটি শুধু রোজার জন্যই নয়, এটি ইসলামী ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এক স্মৃতিদিন। এদিন কারবালার শহীদ হুজরত ইমাম হুসাইন (রা.) এবং তাঁর পরিবার ও সাহাবাদের মহান ত্যাগ ও আত্মত্যাগের স্মরণ করা হয়। কারবালা দিবসের কষ্ট ও যন্ত্রণার স্মৃতিচারণ, মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় মনোবলের শিক্ষা দেয়।

এছাড়াও আশুরার দিন মুসা (আঃ) আল্লাহর সাহায্যে ফেরাউনকে পরাজিত করে তার বান্দেগণকে মুক্ত করেছেন—যার জন্য ইহুদি সম্প্রদায়ও এদিন রোজা পালন করতো।

কীভাবে এই বছর আশুরার রোজা পালন করবেন?

২০২৫ সালে মহররম মাসের ৯ ও ১০ তারিখ যথাক্রমে ৫ ও ৬ জুলাই পড়েছে। মুসলমানরা আশা ও ইচ্ছা অনুযায়ী এই দিনে রোজা পালন করতে পারেন। অধিক সওয়াবের জন্য মহররমের ৯, ১০ অথবা ১০, ১১ তারিখ দুটি রোজা রাখাই উত্তম।

(প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন)

১. আশুরার রোজা রাখার মূল উদ্দেশ্য কী?
উত্তর: আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং নবী মুসা (আঃ)-এর নিদর্শন অনুসরণ করা।

২. কি কারণে দুটি রোজা রাখা হয়?
উত্তর: ইহুদিদের রোজার সাথে মিল না রাখার জন্য ১০ তারিখের সাথে ৯ বা ১১ তারিখেও রোজা রাখা হয়।

৩. আশুরার রোজা কোন মাসে পালন করা হয়?
উত্তর: আরবি সনের প্রথম মাস মহররম মাসে।

আশুরার রোজা ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রোজা, যা নবীজির (সা.) আদর্শ অনুসরণে পালন করা হয়। শুধুমাত্র এক দিনের রোজা নয়, দুটি রোজা রাখা এই দিনে ইসলামের ঐতিহ্য ও ভিন্নতা রক্ষার জন্য অত্যন্ত জরুরি।

আপনি যদি আল্লাহর কাছ থেকে অতিরিক্ত বরকত ও রহমত পেতে চান, তাহলে মহররমের ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখে রোজা রাখুন এবং নবীজির (সা.) আদর্শ অনুসরণ করুন।

আসুন, এই মহিমান্বিত দিনে আমরা সবাই আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি, নিজেদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করি এবং ইসলামের উজ্জ্বল ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও মজবুত করি।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button