
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকার এক বড় রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। ইসরায়েলের অতি-অর্থডক্স ইহুদি দলের শাস পার্টি সরকার থেকে পদত্যাগ করেছে, যা ইসরায়েলি সংসদ নেসেটে নেতানিয়াহুর সরকারকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাতে বাধ্য করেছে।
এই গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রথম জানিয়েছে আল জাজিরা, যেখানে বলা হয়েছে, শাস পার্টি বুধবার (১৬ জুলাই) তাদের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। দলটির পদত্যাগের মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ‘ইহুদি শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা’ সংক্রান্ত আইনের বিরোধ।
শাস পার্টির পদত্যাগ: কারণ ও প্রেক্ষাপট
ইসরায়েলের সব নাগরিকের জন্য সামরিক সেবা বাধ্যতামূলক হলেও, অতি-অর্থডক্স সম্প্রদায় বহু বছর ধরেই এটি নিয়ে বিরোধিতা করে আসছে। ধর্মীয় শিক্ষা ও জীবনযাপনের কারণে তারা সামরিক সেবা থেকে অব্যাহতি দাবি করে। এই বিষয়টি ইসরায়েল সরকারের জন্য একটি নিত্যনতুন রাজনৈতিক ঝামেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শাস পার্টির পদত্যাগের পেছনে দীর্ঘদিন ধরে চলা এই বিরোধই সবচেয়ে বড় কারণ। তারা সরকারে থাকা অবস্থায় এ বিষয়ে সরকারী নীতির সঙ্গে একমত হতে পারেনি। ফলে, বাধ্যতামূলক সামরিক সেবার আইনের কারণে সরকারের জোট ভেঙে পড়েছে।
তবে শাস পার্টি তাদের পদত্যাগের ঘোষণায় স্পষ্ট করেছে, তারা পুরোপুরি নেতানিয়াহুর জোট সরকারের বিরুদ্ধে যাবে না। নির্দিষ্ট কিছু আইনে তারা ভোটে সমর্থন দিতে পারে, কিন্তু সরকারের পতনের জন্য সক্রিয় ভূমিকা নেবে না বলে জানিয়েছে।
নেতানিয়াহুর সংখ্যালঘু সরকার: নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা
গত সপ্তাহের শুরুতেই অন্য একটি অতি-অর্থডক্স দলও নেতানিয়াহুর সরকারের জোট থেকে বেরিয়ে এসেছে। এর ফলে, এখন নেতানিয়াহুর সরকার একটি সংখ্যালঘু সরকার হিসেবে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, তারা সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে, যা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
সংখ্যালঘু সরকার হিসেবে নেতানিয়াহু এখন অনেক বেশি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন ও নীতিনির্ধারণে সরকারকে যথেষ্ট সংগ্রাম করতে হবে। পাশাপাশি, সামরিক নীতি থেকে শুরু করে বিদেশনীতি—সব ক্ষেত্রেই এখন সরকারের ক্ষমতা কমে গেছে।
বিরোধী দলের তীব্র সমালোচনা
শাস পার্টির পদত্যাগের পর ইসরায়েলের বিরোধী দলের এক শীর্ষ নেতা একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেন, নেতানিয়াহু এখন ‘অবৈধ সংখ্যালঘু সরকার’ চালাচ্ছেন। এই সরকার গাজা যুদ্ধ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, তেমনি সৌদি আরব ও সিরিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ার মতো বড় ইস্যুতে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে না।
তিনি আরও মন্তব্য করেন, নেতানিয়াহুর বর্তমান সরকার সব ধরনের বৈধতা হারিয়েছে এবং দ্রুত সরকার পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন।
রাজনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
শাস পার্টির পদত্যাগ নেতানিয়াহুর জন্য এক বড় ধাক্কা হলেও, তা এখনই সরকারের পতনের কারণ হবে না বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তবে সরকারের ক্ষমতা অনেকটাই সংকুচিত হয়েছে।
সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর ফলে এখন নেতানিয়াহুর সরকার আইন প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণে আরো বেশি জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। যেকোনো বড় নীতি পরিবর্তনের জন্য তাকে বিরোধী দল এবং ছোট ছোট দলগুলোর সমর্থন নিতে হবে।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারের স্থায়িত্ব কতদিন টিকবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। ইসরায়েলের সামরিক নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ শান্তি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক—এসব ক্ষেত্রে নেতানিয়াহুর সরকারের পদক্ষেপ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
সামরিক সেবার বিতর্ক: ইসরায়েলের রাজনৈতিক দোলাচল
ইসরায়েলের সমাজে সামরিক সেবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে অংশ নিতে হয়। তবে অতি-অর্থডক্স ইহুদিদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম ব্যতিক্রম। ধর্মীয় পড়াশোনা ও জীবনাচরণের জন্য তারা সামরিক সেবা থেকে অব্যাহতি পায়।
কিন্তু নেতানিয়াহুর সরকার সামরিক সেবার ক্ষেত্রেও কঠোর হতে চাচ্ছে। এই নীতির বিরুদ্ধে অতি-অর্থডক্স সম্প্রদায়ের বিরোধিতাই মূলত শাস পার্টির পদত্যাগের পেছনের প্রধান কারণ।
এই বিতর্ক শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, ইসরায়েলের সামাজিক ও ধর্মীয় কাঠামোতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
ইসরায়েলের রাজনীতিতে শাস পার্টির ভূমিকা
শাস পার্টি ইসরায়েলের অতি-অর্থডক্স ইহুদিদের প্রতিনিধিত্ব করে। এই দলটি ইসরায়েলের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। তাদের ধর্মীয় আদর্শ ও রাজনৈতিক প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে সরকারের নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তারা সাধারণত ধর্মীয় শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় এবং সামরিক সেবা থেকে অব্যাহতি চায়। এই কারণে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সরকারের সঙ্গে তাদের টানাপোড়েন নতুন নয়।
শাস পার্টির এই পদত্যাগ ইসরায়েলি রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক এই রাজনৈতিক অস্থিরতা মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে গাজা যুদ্ধের অবস্থা ও সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্ভাব্য সম্পর্ক উন্নয়নে নেতানিয়াহুর সরকারের অস্থিতিশীলতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বিশ্ব রাজনীতির বিভিন্ন পক্ষ এই সংকট মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। অনেক দেশ আশা করছে, ইসরায়েলের সরকার দ্রুত শক্তিশালী ও স্থিতিশীল হবে যাতে তারা শান্তি ও স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
ইসরায়েলে অতি-অর্থডক্স শাস পার্টির পদত্যাগের ফলে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার এক মারাত্মক সংকটে পড়েছে। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানো এই সংকট সরকারের জন্য বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে। সামরিক সেবা সংক্রান্ত বিতর্ক, বিরোধী দলের তীব্র সমালোচনা, এবং আন্তর্জাতিক চাপে নেতানিয়াহুর সরকারের রাজনীতি এখন অনেকটাই জটিল ও অনিশ্চিত।
এই পরিস্থিতি ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ মোড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামনে সময়ে ইসরায়েলের রাজনীতিতে আরো নাটকীয় পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে।