
গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪২৯ জন। যদিও এই সময়ে মৃত্যুর কোনো ঘটনা ঘটেনি, তবে ডেঙ্গুর প্রকোপ ক্রমেই উদ্বেগজনক রূপ নিচ্ছে।
আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু মৃত্যুহার স্থির
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ১৯ জুলাই শনিবার সকাল ৮টা থেকে ২০ জুলাই রবিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪২৯ জন রোগী।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কারো মৃত্যু হয়নি। যা বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছুটা স্বস্তির হলেও, রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় জনমনে উদ্বেগ রয়ে গেছে।
দেশের কোন বিভাগে কতজন ভর্তি
ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে সর্বোচ্চ ১৩৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এরপর রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে ৭৮ জন, খুলনায় ৫৫ জন এবং রাজশাহী বিভাগে ৪৮ জন। ঢাকার বাইরে ঢাকা বিভাগে ২৪ জন ভর্তি হলেও, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১৮ জন ও দক্ষিণ সিটিতে ৫৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন।
এছাড়া ময়মনসিংহ বিভাগে ১১ জন এবং রংপুর বিভাগে ৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
এভাবে বিভিন্ন বিভাগে নতুন রোগীদের ভর্তি সংখ্যা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ডেঙ্গু এখন শুধুমাত্র রাজধানী কিংবা নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় সীমাবদ্ধ নেই; বরং তা সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়ছে।
সুস্থ হয়ে ফিরছেন অনেকেই, কিন্তু আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৪১১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল ছেড়েছেন। চলতি বছর মোট ১৫ হাজার ৮৯৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছেন।
এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দিক, তবে সুস্থতার পাশাপাশি প্রতিদিন যেভাবে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তা উদ্বেগজনক। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঋতুতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা থাকে এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি না থাকলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।
পূর্ববর্তী বছরের পরিসংখ্যান কী বলছে?
২০২৪ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন মোট ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন। মৃত্যু হয়েছিল ৫৭৫ জনের। আর তার আগের বছর, ২০২৩ সালে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন। একই বছর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।
এই সংখ্যাগুলো দেখে বোঝা যায়, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর বিস্তার গত কয়েক বছরে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যদিও ২০২৫ সালের শুরুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কিছুটা কম ছিল, তবে এখন আবার সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সতর্কবার্তা ও প্রস্তুতি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সাধারণ জনগণকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে গৃহের আশপাশে জমে থাকা পানি অপসারণ করা, ফুলের টব, টায়ার বা ফ্রিজের ট্রে নিয়মিত পরিষ্কার রাখা, মশারি ব্যবহার ও মশানাশক স্প্রে করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মাহমুদ হাসান বলেন, “ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি নয় — সারাবছরই এর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। তবে বর্ষাকালে পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ হয়। ব্যক্তিগত সচেতনতাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ ব্যবস্থা।”
ডেঙ্গুর লক্ষণ ও করণীয়
ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণগুলো হলো — জ্বর, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, গাঁট ও মাংসপেশিতে ব্যথা, চামড়ায় লালচে ফুসকুড়ি, এবং ক্লান্তিভাব। এসব উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই। তাই রোগের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলেই হাসপাতাল বা ক্লিনিকে গিয়ে পরীক্ষা করানো উচিত। রোগীর পানির চাহিদা পূরণ, বিশ্রাম ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই সাধারণত চিকিৎসা করা হয়।
ভবিষ্যৎ করণীয় ও জনসচেতনতাই প্রধান হাতিয়ার
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও, তা যথেষ্ট নয় যদি নাগরিক পর্যায়ে সচেতনতা না বাড়ে। মশার আবাসস্থল ধ্বংস করা, ডাস্টবিন বা ড্রেনে জমে থাকা পানি সরানো এবং নিয়মিত সাফ-সাফাইয়ের মাধ্যমে এই ভাইরাসের বিস্তার রোধ সম্ভব।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশন এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই ডেঙ্গু মোকাবিলা সম্ভব। শুধু একটি পক্ষ সচেতন হলে ডেঙ্গুর মতো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া রোগ থামানো সম্ভব নয়।
“বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত সতর্কতা ও পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার বিকল্প নেই”—স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
সারসংক্ষেপ
ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, রোগটির বিস্তার এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। প্রতিদিনের মতো আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজন সর্বস্তরের সহযোগিতা। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র — সকলকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। এখনই যদি পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে চরম পরিণতি অপেক্ষা করছে — এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এম আর এম – ০৪২৯, Signalbd.com