
যুক্তরাষ্ট্রে ৬০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি চ্যাটজিপিটির দেওয়া ডায়েট প্ল্যান মেনে চলতে গিয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দেওয়া পরামর্শে তিনি সাধারণ লবণের পরিবর্তে সোডিয়াম ব্রোমাইড নামের এক রাসায়নিক ব্যবহার শুরু করেন। তিন মাস ধরে এই পদার্থ গ্রহণের ফলে তার শরীরে ভয়াবহ বিষক্রিয়া দেখা দেয় এবং শেষ পর্যন্ত তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। চিকিৎসকদের নিবিড় পরিচর্যায় কয়েক সপ্তাহ পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
ঘটনার বিস্তারিত
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকরা ‘অ্যানালস অব ইন্টার্নাল মেডিসিন’ নামক একটি চিকিৎসা বিষয়ক জার্নালে এই ঘটনার বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ওই ব্যক্তি নিজের খাবারে অতিরিক্ত সোডিয়াম গ্রহণ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাই অনলাইনে সমাধান খুঁজতে গিয়ে তিনি চ্যাটজিপিটির কাছে বিকল্প পরামর্শ চান। এআই তাকে সাধারণ লবণ (সোডিয়াম ক্লোরাইড) এর পরিবর্তে সোডিয়াম ব্রোমাইড ব্যবহার করতে বলে, কিন্তু এর বিষাক্ত প্রভাব সম্পর্কে কোনো সতর্কতা দেয়নি।
তিনি বিশ্বাস করে তিন মাস ধরে প্রতিদিন খাবারের সঙ্গে সোডিয়াম ব্রোমাইড গ্রহণ করেন, যা আসলে মানুষের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং বহু দেশে খাদ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
শারীরিক জটিলতা ও লক্ষণ
চিকিৎসকদের ভাষ্য অনুযায়ী, সোডিয়াম ব্রোমাইডের দীর্ঘমেয়াদি গ্রহণের ফলে ওই ব্যক্তির শরীরে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। তার মধ্যে বিভ্রান্তি, হ্যালুসিনেশন, স্মৃতিভ্রম, ত্বকে লালচে দাগ এবং মস্তিষ্কে স্নায়বিক গোলযোগ অন্যতম।
প্রথমে তিনি হাসপাতালে আসেন এই অভিযোগ নিয়ে যে, প্রতিবেশীরা তাকে বিষ দিয়েছে। তবে চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে বুঝতে পারেন যে বিষয়টি আসলে রাসায়নিক বিষক্রিয়া।
তিনি প্রচণ্ড তৃষ্ণার্ত থাকলেও পানি খেতে চাইছিলেন না, মানসিক অবস্থা ছিল অস্থির, এবং অস্বাভাবিক আচরণ করছিলেন।
চিকিৎসা ও সুস্থতা
হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর রোগীকে ইন্ট্রাভেনাস ফ্লুইড, অ্যান্টি-সাইকোটিক ওষুধ এবং ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য বিশেষ চিকিৎসা দেওয়া হয়।
তিন সপ্তাহের নিবিড় পরিচর্যা শেষে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয় এবং ধীরে ধীরে মানসিক স্থিতিও ফিরে আসে। পরে তিনি চিকিৎসকদের জানান পুরো ঘটনার পেছনের কারণ—চ্যাটজিপিটির দেওয়া সেই ডায়েট প্ল্যান।
সোডিয়াম ব্রোমাইড: কী এবং কেন ক্ষতিকর
সোডিয়াম ব্রোমাইড মূলত আগে কিছু ওষুধে ব্যবহার করা হতো, বিশেষ করে উদ্বেগ ও অনিদ্রার চিকিৎসায়। তবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে মস্তিষ্কের ক্ষতি ও অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকার কারণে কয়েক দশক আগে মানবদেহে ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বর্তমানে এটি কিছু পশুর ওষুধ এবং শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু খাদ্য হিসেবে একেবারেই নিরাপদ নয়।
এটি মানুষের শরীরে জমে থেকে স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটায়, যা দীর্ঘমেয়াদি রোগ ও মারাত্মক জটিলতার কারণ হতে পারে।
এআই-নির্ভর স্বাস্থ্য পরামর্শের ঝুঁকি
এআই প্রযুক্তি যেমন চ্যাটজিপিটি আজ বিশ্বজুড়ে তথ্য খোঁজার সহজ মাধ্যম হয়ে উঠেছে, তেমনি স্বাস্থ্যসংক্রান্ত পরামর্শের ক্ষেত্রে এটি এখনও পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এআই কোনো চিকিৎসকের বিকল্প হতে পারে না, কারণ এটি সবসময় সঠিক তথ্য দিতে সক্ষম নয় এবং মানুষের শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী কাস্টমাইজড পরামর্শ দেওয়ার ক্ষমতাও সীমিত।
তাই স্বাস্থ্য বা খাদ্যাভ্যাস নিয়ে কোনো পরিবর্তন আনার আগে অবশ্যই পেশাদার চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা
ঘটনাটি প্রকাশের পর চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
তাদের মতে, প্রযুক্তি যত উন্নতই হোক, মানুষের স্বাস্থ্য নির্ধারণে সরাসরি ডাক্তারি পরামর্শ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া সিদ্ধান্ত নেওয়া বিপজ্জনক।
এই ঘটনা বিশ্বজুড়ে মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছে—ডিজিটাল তথ্য গ্রহণে সতর্কতা ও যাচাই করা অপরিহার্য।
শেষ কথা
চ্যাটজিপিটির মতো এআই প্রযুক্তি তথ্যপ্রাপ্তি সহজ করলেও, চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ক্ষেত্রে এটি একমাত্র ভরসা হওয়া উচিত নয়।
নিউইয়র্কের এই ঘটনার মতো উদাহরণ প্রমাণ করে দেয়, ভুল তথ্যের কারণে জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
তাই সচেতনতা ও সঠিক চিকিৎসা পরামর্শ গ্রহণই হতে পারে সুস্থ থাকার মূল চাবিকাঠি।
এম আর এম – ০৭৯৯, Signalbd.com