লেনদেন কর বৃদ্ধির কারণে চাপে পড়বে ছোট কোম্পানি

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যবসায়ীদের জন্য ট্যাক্স ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ছোট ও মাঝারি কোম্পানির জন্য খুশির খবর নয়। কারণ, আগামী অর্থবছর থেকে লেনদেন কর বা টার্নওভার ট্যাক্সের হার বাড়ানো হয়েছে ০.৬ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে। এই পরিবর্তন দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিকভাবে চরম চাপে ফেলবে বলে অভিমত ব্যবসায়ীদের।
লেনদেন কর বৃদ্ধি: এক নজরে
লেনদেন কর মূলত একটি করপোরেট করের রূপ। এটি ব্যবসার মোট লেনদেনের ওপর ধার্য করা হয়, যেটি বিক্রয় বা টার্নওভারের একটি অংশ হিসেবে গণ্য হয়। আগের অর্থবছরে এই কর ছিল মাত্র ০.৬ শতাংশ, যা নতুন বাজেটে বৃদ্ধি পেয়ে ১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এ পরিবর্তনের ঘোষণা দেন। যদিও করের এই বৃদ্ধির পেছনে এনবিআর-এর রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করার লক্ষ্য রয়েছে, ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, এই কর বৃদ্ধির ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাগুলো যে সংকটে পড়বে তা সহজে অতিক্রম করা কঠিন হবে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার ওপর প্রভাব
বিভিন্ন শিল্প খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বর্তমানে অনেক ছোট প্রতিষ্ঠানই সংকটে রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ঋণ সংকট এবং বাজারের অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে তারা বেঁচে থাকার লড়াই করছে। এই সময়ে লেনদেন কর বৃদ্ধির ফলে তাদের আর্থিক চাপ আরও বাড়বে, যা ব্যবসার লোকসানের গতি ত্বরান্বিত করবে।
এফএম প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহম্মদ গাজী তৌহিদুর রহমান বলেন,
“লেনদেন কর বৃদ্ধি ঠিক হয়নি। ব্যবসায় ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও কর দিতে হবে, যা অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে কার্যত বাঁচার জায়গা থেকে সরিয়ে দেবে। বিশেষ করে যারা কম লাভে কাজ করছে, তাদের জন্য এটি বড় বোঝা।”
ফ্যাশন খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সংগঠন, বাংলাদেশ ফ্যাশন উদ্যোক্তা সমিতির (এফইএবি) সভাপতি আজহারুল হক আজাদ উল্লেখ করেন,
“বর্তমানে অনেক ফ্যাশন হাউসই টিকে থাকার সংগ্রাম করছে। এরই মধ্যে লেনদেন কর বৃদ্ধির ফলে ব্যবসায়িক লোকসান বৃদ্ধি পাবে এবং মূলধনের সংকট আরও গভীর হবে। এর প্রভাব সরাসরি কর্মী ছাঁটাই ও উৎপাদন খরচ কমানোর দিকে যেতে বাধ্য করবে।”
ব্যবসায়ীদের আর্থিক বোঝা বাড়বে, রাজস্ব আদায় কি বাড়বে?
যদিও সরকারের দাবি, এই কর বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ানো সম্ভব হবে, ব্যবসায়ীরা মনে করছেন এটি অযথা চাপ সৃষ্টি করবে। অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই লোকসানে রয়েছে। ধরুন কোনো কোম্পানি বছরে ১০০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করল এবং সে সময়ে ১০ কোটি টাকা লোকসান হলো। তবুও তাদের লেনদেন কর দিতে হবে ১ কোটি টাকা। অর্থাৎ লোকসানের মুখেও করের বোঝা কমবে না। এই পরিস্থিতিতে অনেক প্রতিষ্ঠান হয়তো আর টিকে থাকতে পারবে না।
কেপিসি এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান কাজী সাজেদুর রহমান বলেন,
“যেসব কোম্পানি চুরি-ছদ্মবেশে কাজ করছে, তাদের ধরতে কর বাড়ানো হয়। কিন্তু কেন তার বোঝা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ওপর চাপানো হচ্ছে? এটি অমানবিক সিদ্ধান্ত।”
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমানও একথা বলেন,
“এনবিআর যখন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় বাড়াতে পারে, তখনই কর বৃদ্ধির বিকল্প থাকা উচিত। এই কর বৃদ্ধির কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হারে ব্যবসা বন্ধ হতে পারে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো নয়।”
ট্যাক্স ব্যবস্থায় আরও কি পরিবর্তন?
লেনদেন কর ছাড়াও টেলিযোগাযোগ খাতে করের হার ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১.৫ শতাংশ করা হয়েছে। কিন্তু তামাক ও কোমল পানীয় খাতের কর আগের মতোই ৩ শতাংশ রাখা হয়েছে। এতে বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, রাজস্ব আদায় বাড়াতে কর ব্যবস্থা আরও সুবিন্যস্ত ও ন্যায্য হতে হবে।
কর প্রশাসনে অটোমেশন ও আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তা
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এনবিআরকে আরও আধুনিক ও স্বচ্ছ করার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানো যেতে পারে। অটোমেশন এবং তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ালে কর ফাঁকি এবং চুরি আটকানো সম্ভব। তবে সরকার এই দিক থেকে যথেষ্ট মনোযোগ দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে।
কর বৃদ্ধি নিয়ে সরকারের পরবর্তী করণীয়
রাজস্ব বোর্ডকে উচিত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের দুরবস্থা বুঝে কর বৃদ্ধির বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করা। পাশাপাশি কর প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করতে হবে। এতে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত হবে এবং দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতাও বজায় থাকবে।
- লেনদেন কর ০.৬% থেকে ১% করা হয়েছে।
- ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা এই পরিবর্তনে আর্থিক চাপের মুখে পড়বেন।
- ব্যবসায়ীরা সরকারের কর নীতির সমালোচনা করছেন।
- এনবিআরের রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য কর বৃদ্ধির পরিবর্তে আধুনিকায়ন জরুরি।
- ক্ষুদ্র ব্যবসার টিকিয়ে রাখার জন্য কর বৃদ্ধির পুনর্বিবেচনা দাবি।