ঈদ ঘিরে নতুন টাকার বান্ডেলপ্রতি বাড়তি গুনতে হচ্ছে ৮০০-১০০০ টাকা

ঈদুল আজহার আগমনে প্রতিবারের মতো এবারও নতুন টাকার প্রতি মানুষের চাহিদা বেড়েছে বহুগুণে। তবে বাজারে নতুন টাকার সরবরাহ সীমিত থাকায় গুলিস্তান ও মতিঝিলের খোলাবাজারে প্রতিটি বান্ডেলের জন্য গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত। সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত মূল্যে এসব নোট কিনছেন, যা নিয়ে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ ও অসন্তোষ।
ঈদের আগে ব্যাংক ছুটি, সুযোগ নিচ্ছে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা
বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের ঈদের ছুটি শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার (৫ জুন) থেকে। ফলে ব্যাংকের মাধ্যমে নতুন নোট সংগ্রহের সুযোগ শেষ হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে রাজধানীর গুলিস্তান ও মতিঝিল এলাকায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ভ্রাম্যমাণ দোকানে নতুন টাকার বান্ডেল বিক্রি শুরু করেছেন। সকাল থেকে শত শত মানুষকে এসব দোকানে ভিড় করতে দেখা গেছে। তবে অনেকেই চড়া দাম শুনে না কিনেই ফিরে যাচ্ছেন।
মাত্র ৫০০ কোটি টাকার নতুন নোট ছাড়, বাড়তি চাপ বাজারে
প্রতিবছর ঈদের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট বাজারে ছাড়ে। অথচ এবার দেওয়া হয়েছে মাত্র ৫০০ কোটি টাকার নতুন নোট, যা চাহিদার তুলনায় অতি নগণ্য। ব্যাংকগুলোতে সরবরাহ না থাকায় ব্যাংক কর্মকর্তারাও সাধারণ গ্রাহকদের নতুন নোট দিতে পারেননি। ফলে বিকল্প উৎস হিসেবে খোলাবাজার হয়ে উঠেছে অনেকের ভরসা।
কত দাম পড়ছে নতুন টাকার?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন নকশার ২০ ও ৫০ টাকার নোটের প্রতিটি বান্ডেল (১০০টি নোট) ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আর ১ হাজার টাকার নতুন নোটের ক্ষেত্রে প্রতি পিস ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে।
পুরোনো নকশার নতুন নোটও বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে। যেমন—
- ৫ টাকার বান্ডেল: ৩০০ টাকা বাড়তি
- ২০, ৫০, ১০০ টাকার পুরোনো নোটের বান্ডেল: ৪০০–৫০০ টাকা বাড়তি
তবে দরদাম করলে কিছুটা কমেও কেনা যাচ্ছে, তবে তাও ৫০ থেকে ১০০ টাকার বেশি গুনতে হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের ভাষ্য: নিজেরাও কিনেছেন বেশি দামে
গুলিস্তানের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, যিনি ১৯৮০ সাল থেকে নতুন ও পুরোনো টাকা বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত, বলেন, “আমরা বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা ও তৃতীয় পক্ষ থেকে নতুন নোট কিনি। এবার ২০ ও ৫০ টাকার নতুন নোটের প্রতি বান্ডেলে ৬৫০ টাকা বেশি দিয়েই কিনেছি। তাই আমাদেরও বিক্রি করতে হচ্ছে বেশি দামে।”
একইভাবে মতিঝিলের আরেক বিক্রেতা জামাল উদ্দীন বলেন, “নতুন নোট খুব কম এসেছে। বিশেষ করে পুরোনো নকশার নোটও পাওয়া যাচ্ছে না ঠিকমতো। তাই ১০, ২০, ৫০ টাকার বান্ডেলের দাম বেড়েছে।”
ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ
ব্যাংক থেকে নতুন নোট না পেয়ে গুলিস্তানের ভ্রাম্যমাণ দোকানে এসে টাকা কিনেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী আসিফ খান। তিনি বলেন, “বাড়ির দারোয়ান আর গৃহকর্মীদের ঈদের সালামি দেব বলে ৫০ টাকার ১০টি নতুন নোট কিনলাম, বাড়তি ১০০ টাকা গুনতে হয়েছে। গতবার এত বেশি বাড়তি খরচ হয়নি।”
আরও অনেকে জানান, তারা অনেক ব্যাংকে ঘুরেও নতুন নোট পাননি। বাধ্য হয়ে খোলাবাজার থেকে বেশি দামে কিনছেন।
নতুন নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য ও নকশা
এবার বাংলাদেশ ব্যাংক যে নতুন নকশার টাকা বাজারে ছেড়েছে, তা দেখতে আকর্ষণীয় এবং নিরাপত্তার দিক থেকেও উন্নত। নিচে উল্লেখ করা হলো প্রতিটি নোটের বৈশিষ্ট্য:
১,০০০ টাকার নতুন নোট
- কাগজ: শতভাগ সুতি
- জলছাপ: বেঙ্গল টাইগারের মুখ
- রং: বেগুনি আধিক্য
- সামনে: সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ
- ব্যাকগ্রাউন্ড: শাপলা ফুল, পাতা ও কলি
- পেছনে: জাতীয় সংসদ ভবন
৫০ টাকার নতুন নোট
- কাগজ: শতভাগ সুতি
- জলছাপ: বেঙ্গল টাইগারের মুখ
- রং: গাঢ় বাদামি
- সামনে: আহসান মঞ্জিল
- ব্যাকগ্রাউন্ড: শাপলা ফুল, পাতা ও কলি
- পেছনে: শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চিত্র ‘সংগ্রাম’
২০ টাকার নতুন নোট
- কাগজ: শতভাগ সুতি
- জলছাপ: বেঙ্গল টাইগারের মুখ
- রং: সবুজ
- সামনে: কান্তজিউ মন্দির
- ব্যাকগ্রাউন্ড: শাপলা ফুল, পাতা ও কলি
- পেছনে: পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার
বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত খোলাবাজারে অতিরিক্ত দামে নোট বিক্রির বিষয়ে কোনো কঠোর পদক্ষেপের কথা জানানো হয়নি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সীমিত পরিসরে নতুন ও পুরোনো নকশার নোট বাজারে ছাড়া হয়েছে এবং এটি পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মত: নিয়ন্ত্রণ দরকার
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতি বছর ঈদ আসলে একই চিত্র দেখা যায়। নির্ধারিত কিছু ব্যাংক শাখা থেকে সীমিত পরিসরে নতুন টাকা বিতরণ হয়, কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা খুবই কম। ফলে গড়ে ওঠে এক ধরনের কালোবাজার। এসব নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে।
চাহিদা বেশি, সরবরাহ কম—ভোগান্তির শিকার সাধারণ মানুষ
ঈদুল আজহা সামনে রেখে নতুন টাকার চাহিদা যে কতটা বেড়েছে, তা খোলাবাজারের দাম থেকেই পরিষ্কার। কিন্তু সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যথাযথ সরবরাহ নিশ্চিত না করায় সাধারণ মানুষকে গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। এই পরিস্থিতি নিয়মিত মনিটরিং এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধান ছাড়া বদলানো কঠিন।