রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা মোটাদাগে ‘অপরিবর্তিত’ রয়েছে। মেডিকেল বোর্ডের একাধিক চিকিৎসক নিশ্চিত করেছেন যে, তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল থাকলেও তিনি এখনও বিমানযাত্রার সক্ষমতা অর্জন করতে পারেননি। এই কারণে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁর লন্ডন যাত্রা বিলম্বিত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার বিএনপির পক্ষ থেকে শুক্রবার সকালে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাঁকে লন্ডনে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেও, শারীরিক অবস্থার অবনতি এবং ‘কারিগরি ত্রুটির’ কারণে সেই সিদ্ধান্ত স্থগিত হয়। তবে চিকিৎসকরা আশাবাদী যে, পজেটিভ সাইনগুলো অব্যাহত থাকলে আগামী ৯-১০ ডিসেম্বরের দিকে তিনি ফ্লাই করার সক্ষমতা অর্জন করতেও পারেন।
লন্ডন যাত্রায় বিলম্ব ও শারীরিক সক্ষমতা
মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বেগম খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর বর্তমান শারীরিক সক্ষমতাই সবচেয়ে বড় বাধা। প্রায় ৮০ বছর বয়সী এই নেত্রী দীর্ঘদিন ধরে হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, লিভার সিরোসিস ও কিডনির জটিলতাসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। এই অবস্থায় দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের ধকল সামলানো তাঁর জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
- চিকিৎসকদের মত: শনিবার দুপুরে মেডিকেল বোর্ডের এক চিকিৎসক বলেন, “অনেকগুলো প্যারামিটার পজেটিভ সাইন দিচ্ছে, তবে অবস্থার উন্নতি হয়েছে এমনটা এখনই বলা যাচ্ছে না। আমরা আশা করছি, পজেটিভ সাইন অব্যাহত থাকলে উনি ৯-১০ তারিখের (ডিসেম্বর) দিকে ফ্লাই করার সক্ষমতা অর্জন করতেও পারেন।”
- পূর্বের ঘোষণা: এর আগে বৃহস্পতিবার বিএনপির পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, কাতারের পাঠানো এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে শুক্রবার সকালে তাঁকে লন্ডনে পাঠানো হবে। তবে শুক্রবার সকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, ‘কারিগরি ত্রুটির কারণে’ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স শুক্রবার আসছে না এবং সব ঠিক থাকলে সেটা শনিবার পৌঁছাতে পারে। তবে এখন জানা যাচ্ছে, বিলম্বের প্রধান কারণ তাঁর শারীরিক সক্ষমতা।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও এয়ার অ্যাম্বুলেন্স বিতর্ক
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে যুক্তরাজ্যে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর জানানো হয়, গত জানুয়ারির মতো এবারও কাতারের আমিরের বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে লন্ডনে পাঠানো হবে। তবে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে কিছু বিতর্ক তৈরি হয়:
- কাতার দূতাবাসের স্পষ্টতা: ঢাকায় কাতার দূতাবাসের জনসংযোগ কর্মকর্তা আসাদুর রহমান আসাদ শুক্রবার বিকালে জানান, কাতারের আমিরের (রয়্যাল ফ্লিটের) এয়ার অ্যাম্বুলেন্স আসছে না। তবে কাতার সরকার জার্মানির একটি কোম্পানি থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে দিচ্ছে, যেটা ঢাকায় এসে খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নিয়ে যাবে।
- এনামুল হক চৌধুরীর বক্তব্য: বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এনামুল হক চৌধুরী এই বিষয়ে স্পষ্টতা এনে বলেন, “জার্মানি থেকে অ্যাম্বুলেন্স আসছে, এটা ঠিক আছে। আমরা নই, কাতার কর্তৃপক্ষই জার্মানি থেকে একটি অত্যাধুনিক এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের অ্যারেঞ্জমেন্ট করে দিচ্ছেন। অর্থাৎ বিএনপি চেয়ারপারসন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জন্য রয়েল কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়নে সবকিছু হচ্ছে।”
মেডিকেল বোর্ডের তত্ত্বাবধান ও সমন্বয়
গত ২৩ নভেম্বর থেকে খালেদা জিয়া এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ড তাঁর চিকিৎসা দিচ্ছেন। এই বোর্ডে তাঁর পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমানও সদস্য হিসেবে রয়েছেন এবং তিনি লন্ডন থেকে সার্বক্ষণিক সমন্বয় করছেন।
- নিয়মিত পর্যালোচনা: চিকিৎসকরা শনিবার বলছেন, গত দুই দিনে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে, সেসব প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হচ্ছে। শুক্রবার দুই দফা মেডিকেল বোর্ড বৈঠক করেছে এবং প্রতিদিনই খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার নিয়মিত প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
- বিদেশের প্রস্তুতি: বোর্ডের সিদ্ধান্তক্রমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায় আসবে এবং তাঁকে লন্ডনের একটি নির্ধারিত হাসপাতালে নেওয়া হবে। তাঁর সঙ্গে তাঁর পুত্রবধূ শর্মিলা (শামিলা) রহমান, কয়েকজন চিকিৎসক ও কর্মকর্তাও থাকবেন।
তারেক রহমানের ভূমিকা ও এসএসএফের নিরাপত্তা
খালেদা জিয়ার বড় পুত্র তারেক রহমান লন্ডন থেকে সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন। তাঁর সহধর্মিণী ডা. জুবাইদা রহমানও মায়ের সঙ্গে লন্ডন যাওয়ার জন্য ঢাকায় আসার চেষ্টা করছেন।
এদিকে, বেগম জিয়াকে রাষ্ট্রের ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ (VIP) ঘোষণার পর থেকেই এভারকেয়ার হাসপাতাল এলাকার নিরাপত্তায় এসএসএফ (SSF) ও পিজিআর (PGR) সদস্যরা নিয়োজিত আছেন। তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বার বার অনুরোধ করছেন, যেন নেতাকর্মীরা হাসপাতালে ভিড় না করেন।
স্বস্তির অপেক্ষা
বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা মোটাদাগে অপরিবর্তিত থাকা এবং বিমানযাত্রার সক্ষমতা অর্জিত না হওয়ায় তাঁর লন্ডন যাত্রা আপাতত বিলম্বিত হচ্ছে। তবে চিকিৎসকদের দেওয়া আশাব্যঞ্জক ইঙ্গিত অনুযায়ী, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে তিনি ফ্লাই করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সরকার ও আন্তর্জাতিক মহল সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছে। এখন সবার অপেক্ষা সেই মুহূর্তের জন্য, যখন মেডিকেল বোর্ড সবুজ সংকেত দেবে এবং বেগম খালেদা জিয়া নিরাপদে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডন যেতে পারবেন।
এম আর এম – ২৫২৩, Signalbd.com



