দেশে শ্বাসযন্ত্রের রোগী প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো বায়ুদূষণ এবং আধুনিক জীবনধারার পরিবর্তন। ফুসফুস মানুষের শরীরের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি শরীরকে অক্সিজেন সরবরাহ করে, দেহের কোষগুলোকে সুস্থ রাখে এবং বিভিন্ন ধরনের রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। কিন্তু বর্তমান পরিবেশ ও জীবনধারার কারণে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, নিউমোনিয়া এবং সিওপিডি সহ বিভিন্ন বক্ষরোগের প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
এই রোগের কারণ, প্রভাব এবং প্রতিকার নিয়ে কথা হলো মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আলী হোসেন-এর সঙ্গে।
শ্বাসযন্ত্রের রোগ বাড়ার কারণ
প্রশ্ন: বর্তমানে হাঁপানি, নিউমোনিয়া বা সিওপিডি রোগীর সংখ্যা কি বাড়ছে?
উত্তর: হ্যাঁ, এই তিনটি রোগ আমাদের দেশে ক্রমবর্ধমান। এর প্রধান কারণ হলো বায়ুদূষণ। বিশ্বের মধ্যে বায়ুদূষণের দিক দিয়ে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহর এ বিষয়ে অগ্রণী।
শহরায়নের দ্রুত বৃদ্ধি, অতিরিক্ত বিল্ডিং নির্মাণ, যানবাহনের ধোঁয়া, কলকারখানার অব্যবস্থাপনা—all মিলিয়ে বায়ুদূষণ বেড়েছে। এছাড়া করোনার ভ্যাকসিন গ্রহণের আগে এবং পরে শরীরের ইমিউনিটি পরিবর্তনের ফলে শ্বাসযন্ত্রের রোগীদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। তাই হাঁপানি, নিউমোনিয়া এবং সিওপিডি-র মতো রোগ দেশের শহরাঞ্চলে আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে।
ধুলাবালি, ধূমপান ও শহরায়নের প্রভাব
প্রশ্ন: ধুলাবালি, বায়ুদূষণ ও ধূমপান কতোটা মারাত্মক প্রভাব ফেলছে?
উত্তর: এটি একটি বিশাল সমস্যা। শহরে বায়ুদূষণের মাত্রা গ্রামের তুলনায় অনেক বেশি। ধূমপায়ীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসকষ্টের রোগ, বিশেষ করে হাঁপানি এবং সিওপিডি, বাড়ছে। আমাদের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেখা যায়, শহরে বক্ষরোগীদের সংখ্যা গ্রামাঞ্চলের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
শহরের যানবাহন, শিল্প কারখানা, ইটভাটার ধোঁয়া, ধুলাবালি—all মিলিয়ে মানুষের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণের নিয়মিত মনিটরিং এবং সচেতনতা বৃদ্ধি না হলে, ভবিষ্যতে এই সমস্যা আরও জটিল আকার নেবে।
যক্ষ্মা এখনও বড় চ্যালেঞ্জ
প্রশ্ন: বাংলাদেশে যক্ষ্মা (TB) এখনও একটি বড় সমস্যা। প্রতিরোধে কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
উত্তর: যক্ষ্মা প্রতিরোধের জন্য দুইটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে:
১. প্রারম্ভিক শনাক্তকরণ: রোগ শুরুর প্রথম পর্যায়ে শনাক্ত করতে পারলে এটি ছড়াতে পারে না।
২. পূর্ণ চিকিৎসা কোর্স সম্পন্ন করা: অনেক রোগী কয়েকদিন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ বলে মনে করে চিকিৎসা বন্ধ করে দেন। এটি রোগকে পুনরায় বাড়ায়। সাধারণত যক্ষ্মার চিকিৎসা ছয় মাসের হয়।
ডা. আলী হোসেন বলেন, “যক্ষ্মা এখনও দেশের স্বাস্থ্য খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। আমাদের গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চলে একরূপ সচেতনতা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।”
লাং ফাউন্ডেশন এবং চিকিৎসা সেবার সম্প্রসারণ
প্রশ্ন: লাং ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আপনার ভাবনা কী?
উত্তর: লাং ফাউন্ডেশন গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলে সমানভাবে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেওয়ার উপর কাজ করছে। আমরা প্রতি দুই বছর পরপর একটি জাতীয় কনফারেন্স আয়োজিত করি, যেখানে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ১,৫০০ চিকিৎসক অংশগ্রহণ করেন। এই কনফারেন্সের মাধ্যমে চিকিৎসকরা নতুন চিকিৎসা প্রযুক্তি ও জ্ঞান নিয়ে গ্রামীণ অঞ্চলে ফিরে চিকিৎসা প্রদান করেন।
ডা. আলী হোসেন বলেন, দেশে বক্ষব্যাধি চিকিৎসা ও গবেষণার প্রচুর সুযোগ রয়েছে। তবে ডায়াগনস্টিক সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন, বিশেষ করে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে। এক্সরে, সিটি স্ক্যান এবং অন্যান্য আধুনিক যন্ত্র সরবরাহ করলে রোগ দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হবে।
প্রযুক্তি এবং এআই-এর ভূমিকা
প্রশ্ন: চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রযুক্তি, যেমন Chest CT Scan, AI Diagnosis কীভাবে পরিবর্তন আনছে?
উত্তর: প্রযুক্তি, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), চিকিৎসায় বিপ্লব ঘটাচ্ছে। AI ব্যবহার করে ফুসফুসের রোগ দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব।
একটি উদাহরণ দিলে সহজ হবে—একজন রোগীর এক্সরে নরমাল দেখাতে পারে, কিন্তু AI-র সাহায্যে করা এক্সরে বা সিটি স্ক্যান থেকে রোগ শুরুতেই শনাক্ত করা সম্ভব। এর ফলে রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা শুরু করা যায়, যা রোগীকে গুরুতর অবস্থার থেকে রক্ষা করে।
ডা. আলী হোসেন বলেন, “AI-ভিত্তিক ডায়াগনস্টিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলে রোগ নির্ণয়ে সময় কমে এবং চিকিৎসার কার্যকারিতা বেড়ে যায়। এটি আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতে নতুন দিগন্ত খুলেছে।”
বায়ুদূষণ ও শহরায়নের সমাধান
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহরের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা হলে শ্বাসযন্ত্রের রোগ অনেকাংশে কমানো সম্ভব। এর জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
- শিল্প-কারখানা নিয়ন্ত্রণ: ধোঁয়া ও বর্জ্য নির্গমন নিয়মিত পর্যবেক্ষণ।
 - পরিবহন ব্যবস্থার সংস্কার: যানবাহনের সংখ্যাকে সীমিত করা ও পলিউশন কমানো।
 - সবুজায়ন বৃদ্ধি: শহরের মধ্যে বৃক্ষরোপণ ও পার্ক তৈরির মাধ্যমে বায়ুদূষণ কমানো।
 - সচেতনতা বৃদ্ধি: ধূমপান ও খোলা জায়গায় ধূম্রপান এড়ানোর জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি।
 - গ্রামীণ-শহর স্বাস্থ্য সমতা: শহর ও গ্রামে সমান চিকিৎসা সুবিধা পৌঁছে দেওয়া।
 
শহরে বক্ষরোগের ভবিষ্য
বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্বাসযন্ত্রের রোগের সংখ্যা আগামী বছরগুলোতে আরও বাড়তে পারে, যদি পরিবেশ দূষণ এবং আধুনিক জীবনধারার প্রতিকূল প্রভাব নিয়ন্ত্রণ না করা যায়। তাই সরকার, স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, শিল্পক্ষেত্র এবং সাধারণ মানুষকে একসাথে কাজ করতে হবে।
ডা. আলী হোসেন বলেন, “শ্বাসযন্ত্রের রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা, প্রাথমিক শনাক্তকরণ এবং আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি অপরিহার্য। শহরে রোগীদের সংখ্যা বেশি হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু গ্রামে সেবার অভাবে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।”
বাংলাদেশে শ্বাসযন্ত্রের রোগের সংখ্যা বাড়ছে। শহরাঞ্চলে বায়ুদূষণ, ধূমপান এবং শহরায়ন এর মূল কারণ। তবে প্রযুক্তি, প্রাথমিক চিকিৎসা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করে এই সমস্যা অনেকাংশে সমাধান করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতে শ্বাসযন্ত্রের রোগ মোকাবিলায় গবেষণা, প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সমতাপূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, নিউমোনিয়া, সিওপিডি এবং যক্ষ্মা—এই সব রোগের বিরুদ্ধে আমাদের সমন্বিত প্রচেষ্টা ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন।
MAH – 13613 I Signalbd.com
				
					


