বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় অবস্থিত ৩৪টি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাস। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ২৯ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হওয়ায় ক্যাম্পজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার (২ জুন) প্রথমবারের মতো একজন রোহিঙ্গার মৃত্যুর পর তার নমুনা পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়। ওই ঘটনার পর থেকেই কুতুপালং, বালুখালী ও লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে ব্যাপক সতর্কতা জারি করা হয়।
বর্তমানে আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ৭৫৯ জন রোহিঙ্গাকে পৃথকভাবে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি, তিন হাজার ছয়শ’ পরিবারের প্রায় ১৬ হাজার রোহিঙ্গাকে সম্পূর্ণ লকডাউনের আওতায় আনা হয়েছে।
প্রথম মৃত্যুর পর বাড়ছে উদ্বেগ
উখিয়ার কুতুপালং (পূর্ব) ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (সিআইসি) মোহাম্মদ খলিলুর রহমান খান জানান, তার ক্যাম্পের সি ব্লকে বসবাসরত এক রোহিঙ্গা সম্প্রতি জ্বর ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুর পর তার নমুনা পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ আসে।
তিনি বলেন, “মৃত ব্যক্তির পরিবার ও তার ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা সবাইকে ইতিমধ্যে কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে মরদেহ দাফন সম্পন্ন হয়েছে।”
এই মৃত্যুর ঘটনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ভয়াবহ উদ্বেগ তৈরি করেছে। কারণ, ঘনবসতিপূর্ণ এসব আশ্রয়কেন্দ্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা কার্যত অসম্ভব। ফলে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আরআরআরসি কার্যালয়ের সতর্কতা ও পদক্ষেপ
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. সামছু-দ্দৌজা জানান, “রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রথমবারের মতো করোনায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। আমরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, আইওএম, ইউএনএইচসিআরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে মাইকিং, লিফলেট বিতরণ, মাস্ক সরবরাহ ও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। যারা আক্রান্ত বা উপসর্গে ভুগছেন, তাদের দ্রুত শনাক্ত ও চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু রয়েছে।”
ক্যাম্পে সংক্রমণের ঝুঁকি কেন বেশি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শরণার্থী এলাকা। প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা মাত্র ২৬ বর্গকিলোমিটার জায়গায় বসবাস করছে। ফলে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এখানে প্রায় অসম্ভব।
একই সঙ্গে বেশিরভাগ পরিবারের সদস্য সংখ্যা গড়ে ৬ থেকে ৮ জন। ছোট ছোট টিনের ঘরে তারা গাদাগাদি করে বসবাস করেন। পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা না থাকায় সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যদি ভাইরাসটি বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। পর্যাপ্ত হাসপাতাল ও আইসোলেশন সেন্টার না থাকায় চিকিৎসার চাপও বাড়বে।
কক্সবাজার জেলায় করোনার সার্বিক পরিস্থিতি
২০২০ সালের মে-জুন মাসে কক্সবাজারে করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। জেলার সাধারণ জনগণের পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও সংক্রমণ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, সে সময় পুরো জেলায় ৩০০ জনের বেশি মানুষ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ৪০ জন ছিলেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্য। স্থানীয় প্রশাসন জেলা জুড়ে ১৪টি লকডাউন জোন ঘোষণা করে।
রোহিঙ্গা শিবিরে মানবিক সংকট আরও ঘনীভূত
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে ২০১৭ সালের আগস্টে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, তখন থেকে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নিয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অনেক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা সীমিত হয়ে পড়ে। ফলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে মানবিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়।
ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা জানায়, করোনার ভয়ে এখন অনেকেই চিকিৎসা নিতে ভয় পাচ্ছেন। অনেক পরিবার খাবারের সংকটে ভুগছে। শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না, নারীরা স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না।
সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগ
বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (UNHCR), আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (IOM), এবং বিভিন্ন এনজিও মিলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনা প্রতিরোধে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে:
- ক্যাম্পে কোভিড-১৯ সচেতনতা প্রচারণা
- ২৪ ঘণ্টার হেল্পলাইন সেবা
- আইসোলেশন ও চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন
- স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ
- হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক বিতরণ
- খাবার ও জরুরি ওষুধ সরবরাহ
UNHCR-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি জোহানেস ভ্যান ডার ক্লাও জানিয়েছেন, “আমরা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুরক্ষায় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশ সরকারকে আমরা সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি।”
বিশ্বের নজর কক্সবাজারের দিকে
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুধু বাংলাদেশের নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ মানবিক সহায়তা বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছে।
জাতিসংঘও সতর্ক করে বলেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যদি করোনা মহামারি ভয়াবহ রূপ নেয়, তাহলে তা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বড় বিপদ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা
বিশেষজ্ঞদের মতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বাস্থ্যসেবা সীমিত এবং জনগোষ্ঠী ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় করোনা প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রয়োজন। টিকাদান কার্যক্রম, স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং চিকিৎসা অবকাঠামো উন্নত না হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের সংক্রমণ আবারও দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, তারা আন্তর্জাতিক সহায়তায় ক্যাম্পে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ধীরে ধীরে ভাসানচরে স্থানান্তরের প্রক্রিয়াও চলছে, যাতে ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্পের চাপ কিছুটা কমানো যায়।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় মানবিক ও স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ। আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা ও কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা যেমন জরুরি, তেমনি তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টাতেই এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব। মানবিক সহানুভূতি, সঠিক পরিকল্পনা এবং কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানলেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনার বিস্তার রোধ করা যেতে পারে।
MAH – 13559 I Signalbd.com



