
মানুষের দেহে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণার উপস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। কেবল খাবার বা পানীয়ের সঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়, মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন আমাদের রক্তে, অস্থিমজ্জায় এবং এমনকি মস্তিষ্কেও শনাক্ত করা গেছে। গবেষকরা বলছেন, এগুলো শুধু শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে প্রভাবিত করছে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে হাড় ও মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যও বিপন্ন করতে পারে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক কী এবং কেন এটি বিপজ্জনক
মাইক্রোপ্লাস্টিক হল প্লাস্টিকের খুব ছোট কণা, যা সাধারণত পাঁচ মিলিমিটারের কম আকারের। এটি প্রধানত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে তৈরি হয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও এগুলো ছড়িয়ে আছে—প্লাস্টিকের বোতল, খাদ্য প্যাকেজিং, সিনথেটিক কাপড়, এমনকি বাতাসের মধ্যেও। মানুষের শরীরে এই কণাগুলি প্রবেশ করছে মূলত তিনটি পথে:
- খাবারের মাধ্যমে: মাছ, সামুদ্রিক খাদ্য বা প্রক্রিয়াজাত খাবারের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিক।
- পানির মাধ্যমে: বোতলজাত পানি ও অপরিষ্কার পানিতে উপস্থিত ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা।
- শ্বাসপ্রণালী থেকে: বাতাসে থাকা ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা যখন আমরা শ্বাসের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করি।
অস্থিমজ্জা ও হাড়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি
ব্রাজিলের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব কাম্পিনাসের চিকিৎসাবিজ্ঞানী রদ্রিগো বুয়েনো দে অলিভেইরা সম্প্রতি জানিয়েছেন, গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, মাইক্রোপ্লাস্টিক অস্থি এবং অস্থিমজ্জার গভীরে পৌঁছে যাচ্ছে। এতে হাড়ের টিস্যুর বিপাক প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
একটি পর্যালোচনা গবেষণায় ৬২টি পৃথক গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, মানুষের হাড়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি হাড়ের স্বাস্থ্য এবং বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। প্রাণীর উপর করা গবেষণায় দেখা গেছে, হাড়ের বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি হয় এবং হাড়ের মেরামত ও বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণকারী কোষের কার্যক্ষমতা কমে যায়। এতে হাড় দুর্বল হয়, বিকৃত বা ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
হাড়ের কোষে প্রভাব
অলিভেইরা আরও ব্যাখ্যা করেন, ইন ভিট্রো (ল্যাবরেটরিতে) গবেষণায় দেখা গেছে, মাইক্রোপ্লাস্টিক হাড়ের কোষের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। কোষ দ্রুত বার্ধক্যের দিকে চলে যায় এবং কোষের ভিন্নকরণ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনে। এছাড়াও প্রদাহ সৃষ্টি হয়, যা হাড়ের স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বিশ্বজুড়ে অস্টিওপোরোসিস রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অস্টিওপোরোসিস এমন একটি রোগ যেখানে হাড় ভঙ্গুর হয়ে যায় এবং সহজে ভেঙে পড়ে। গবেষকরা মনে করছেন, মাইক্রোপ্লাস্টিকও এর একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। তবে, বয়স বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত ঝুঁকি, অপর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম গ্রহণ এবং মদ্যপানও হাড়ের দুর্বলতার জন্য পরিচিত কারণ।
মস্তিষ্কেও উপস্থিতি
মাইক্রোপ্লাস্টিক শুধু হাড়ে সীমাবদ্ধ নয়। গবেষণার বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এগুলি মস্তিষ্কের কোষেও প্রবেশ করছে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে মস্তিষ্কে প্রদাহের সম্ভাবনা বাড়তে পারে, যা স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
পরিবেশ এবং মানবদেহে মাইক্রোপ্লাস্টিকের বিস্তার
প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক তৈরি হয়। এর সাথে সাথে বছরে ১৮০ কোটি মেট্রিক টন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়। প্লাস্টিকের উৎপাদন, ব্যবহারের পরে নির্গমন, বর্জ্য নিষ্পত্তি সব মিলিয়ে এটি পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বিপদ সৃষ্টি করছে।
গবেষকরা বলছেন, আমাদের দেহে এই ক্ষতিকর প্লাস্টিকের প্রভাব নির্ধারণ করতে আরও অনেক গভীর গবেষণার প্রয়োজন। যেহেতু এটি মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করছে, তাই ভবিষ্যতে অজানা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
মাইক্রোপ্লাস্টিকের ক্ষতি কমানোর উপায়
যদিও সম্পূর্ণভাবে এ থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন, কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব কমানো সম্ভব।
- পরিষ্কার পানি ব্যবহার: ফিল্টারযুক্ত পানি পান করা।
- প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিত করা: বোতলজাত পানীয়, সিনথেটিক কাপড়ের পরিবর্তে প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করা।
- সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহার এবং পরিবেশবান্ধব উপায়ে নিষ্পত্তি।
- খাবার ও পানির উৎস মনিটরিং: সামুদ্রিক খাদ্য এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারে প্লাস্টিকের উপস্থিতি যাচাই করা।
বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা
বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা পুনরায় সতর্ক করে বলছেন, মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন “অপর্যাপ্তভাবে স্বীকৃত একটি বিপদ”। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর বিস্তার ক্রমেই ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। তাই, শুধু গবেষণা নয়, জনসচেতনতা এবং পরিবেশ বান্ধব অভ্যাসও অত্যন্ত জরুরি।
রদ্রিগো বুয়েনো দে অলিভেইরা বলেন, “যদি আমরা এখনই পদক্ষেপ না নেই, তাহলে ভবিষ্যতে হাড় এবং মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগের সঙ্গে মানুষের শরীরের প্লাস্টিকের উপস্থিতি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য ঝুঁকি হিসেবে দাঁড়াবে।”
মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের জীবনে শুধুমাত্র পরিবেশগত সমস্যা নয়, বরং এটি সরাসরি মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে প্রভাবিত করছে। অস্থি, অস্থিমজ্জা, মস্তিষ্ক, প্রজনন অঙ্গ এবং রক্তে এর উপস্থিতি উদ্বেগজনক। প্রতিদিন আমরা যে খাবার খাচ্ছি, পানি পান করছি এবং বাতাস শ্বাস নিচ্ছি, তাতে মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে।
তাই আমাদের জন্য এখন সময় এসেছে সচেতন হওয়ার, জীবনধারায় পরিবর্তন আনার এবং বিজ্ঞানীরা যে সতর্কবার্তা দিচ্ছেন তা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করার। প্লাস্টিক ব্যবহারে যত্নবান হওয়া, পুনর্ব্যবহার ও পরিবেশবান্ধব জীবনধারা নেওয়া—এগুলো আমাদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ দুটোকেই রক্ষা করতে পারে।
MAH – 13173 I Signalbd.com