জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে জীবন রক্ষাকারী সব ওষুধের মূল্য সরকারকে নির্ধারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে সরকারের ক্ষমতা সীমিত করে ১৯৯৪ সালে জারি করা একটি বিতর্কিত সার্কুলারকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সোমবার (২৪ নভেম্বর) বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান এবং বিচারপতি বিশ্বজিৎ দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। এর আগে চলতি বছরের ২৫ আগস্ট আদালত রুল নিষ্পত্তি করে রায়টি ঘোষণা করেছিলেন। আদালত তাঁর রায়ে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ওষুধ যেহেতু মানুষের বেঁচে থাকার অপরিহার্য উপাদান, তাই এর মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা কোনোভাবেই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকতে পারে না।
হাইকোর্টের নির্দেশনা ও রায়ের মূল ভিত্তি
হাইকোর্টের রায়ে জনগণের মৌলিক অধিকার এবং দেশের প্রচলিত ওষুধের আইনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
- সার্কুলার বাতিল: হাইকোর্ট ১৯৯৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা ওই সার্কুলারটিকে আইনের পরিপন্থি উল্লেখ করে অবৈধ ঘোষণা করেন। ওই সার্কুলারের মাধ্যমে সরকার ১১৭টি ওষুধ ছাড়া বাকি সব ওষুধের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের হাতে দিয়েছিল।
- সরকারের এখতিয়ার: আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৮২ সালের ওষুধ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ, যা বর্তমানে ওষুধ ও কসমেটিক্স আইন, ২০২৩ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে, তার বিধান অনুযায়ী ওষুধের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ সরকারের এখতিয়ার। এই এখতিয়ার সীমিত করার কোনো সুযোগ সরকারের নেই।
- গেজেট প্রকাশের নির্দেশ: আদালত যথাযথ কর্তৃপক্ষকে দ্রুত জীবন রক্ষাকারী ওষুধের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ করার নির্দেশনা দিয়েছেন, যাতে জনগণ উপকৃত হয়।
কেন এই আইনি চ্যালেঞ্জ?
ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের ক্ষমতা সীমিত করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনস্বার্থে এই রিট দায়ের করা হয়েছিল।
- রিট দায়ের: ১৯৯৪ সালের সার্কুলারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জনস্বার্থে কাজ করা সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) ২০১৮ সালে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করে।
- আইনজীবী মনজিল মোরসেদের যুক্তি: রিটকারী আইনজীবী এবং সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ আদালতে যুক্তি দেন যে, ওষুধ মানুষের জীবন রক্ষার অপরিহার্য উপাদান। ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি ও নিয়ন্ত্রণহীনতা সরাসরি নাগরিকের বেঁচে থাকার অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। সরকারের ক্ষমতা সীমিত করার ওই সার্কুলার ছিল সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি।
- ১৯৯৩ সালের পদক্ষেপ: উল্লেখ্য, এর আগে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৮২ অনুযায়ী সরকার ১৯৯৩ সালে মোট ৭৩৯টি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ করেছিল। কিন্তু ১৯৯৪ সালের সংশোধিত নীতিতে মাত্র ১১৭টি ওষুধের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের হাতে রাখা হয়, যা ওষুধের বাজারকে কার্যত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দিয়েছিল।
এই রায়ের প্রভাব ও তাৎপর্য
হাইকোর্টের এই ঐতিহাসিক রায়টি দেশের ওষুধ শিল্প, জনস্বাস্থ্য এবং ভোক্তার অধিকারের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
- ভোক্তার সুরক্ষা: এই রায়ের ফলে দেশের সাধারণ মানুষ উচ্চমূল্যের ওষুধের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের পূর্ণ ক্ষমতা ফিরে পাওয়ায়, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্র দাম বাড়ানোর প্রবণতা কমবে, যা সরাসরি ভোক্তাদের স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় কমাবে।
- বেঁচে থাকার অধিকার: আইনজীবীরা বলছেন, এই রায় স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী আইনি ভিত্তি তৈরি করবে। চিকিৎসা ব্যয় কমাতে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি।
- ওষুধ শিল্পের প্রতিক্রিয়া: হাইকোর্টের এই রায়ের ফলে দেশের ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা চাপের মুখে পড়তে পারে। এত দিন তারা বাজার ও চাহিদা অনুযায়ী নিজেরা দাম নির্ধারণ করত, যা এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণের অধীনে আসবে। তবে তাদের অবশ্যই জনস্বাস্থ্যের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞদের মতামত
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদরা হাইকোর্টের এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন এবং এর দ্রুত বাস্তবায়নের উপর জোর দিয়েছেন।
- বাজার নিয়ন্ত্রণ: অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশের ওষুধের বাজারকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করে দেওয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। জরুরি ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সরকার একদিকে যেমন জীবন রক্ষা করতে পারে, তেমনি অন্যদিকে বাজারে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা বজায় রাখতে পারে।
- বিশ্বের চিত্র: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের অনেক দেশেই জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম সরকার কর্তৃক কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে বহু মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বহন করার ক্ষমতা সীমিত, সেখানে এই ধরনের নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত প্রয়োজন।
- বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ: বিশ্লেষকদের মতে, সরকার যেন কার্যকরভাবে ওষুধের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করতে পারে, তার জন্য একটি স্বচ্ছ ও দক্ষ প্রক্রিয়া তৈরি করা চ্যালেঞ্জিং। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরকে শক্তিশালী করা এবং উৎপাদন ব্যয়, কাঁচামালের দাম ও আমদানির তথ্য যাচাই করে ন্যায্য মূল্য নির্ধারণের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে।
সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ (কোট): “ওষুধ যেহেতু জীবন রক্ষার অপরিহার্য উপাদান, মূল্য বৃদ্ধি ও নিয়ন্ত্রণহীনতা সরাসরি নাগরিকের বেঁচে থাকার অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই সরকারের ক্ষমতা সীমিত করার ওই সার্কুলার মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি।”
স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় আনা
ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের ক্ষমতা সীমিত করে দেওয়া ১৯৯৪ সালের সার্কুলারকে হাইকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষণার এই রায় বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য এবং আইনি ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। আদালত এই রায়ের মাধ্যমে জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। এখন সরকারের উচিত দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই নির্দেশনার যথাযথ বাস্তবায়ন করা। জীবন রক্ষাকারী সব ওষুধের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হলে তা দেশের কোটি কোটি মানুষের চিকিৎসা সহজলভ্য করবে এবং জনস্বাস্থ্যের মানোন্নয়নে এক বিশাল ভূমিকা রাখবে। এই পদক্ষেপটি প্রমাণ করে যে, আদালত নাগরিকের মৌলিক অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে কতটা সচেতন।
এম আর এম – ২৩৬১,Signalbd.com



