দেশজুড়ে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব ক্রমেই উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণে ২ জন ও ঢাকা উত্তরে ২ জন। একই সময়ে, ৮৪৫ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে রবিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতকাল সকাল ৮টা থেকে আজ সকাল ৮টা পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা নিম্নরূপ:
- ঢাকা মহানগর: ২০৯ জন
- বরিশাল বিভাগ: ১৬৬ জন
- ঢাকা বিভাগ (মহানগরের বাইরে): ১৬৪ জন
- চট্টগ্রাম বিভাগ: ৯১ জন
- রাজশাহী বিভাগ: ৫৪ জন
- খুলনা বিভাগ: ১০১ জন
- ময়মনসিংহ বিভাগ: ৩৭ জন
এর আগে, গত রোববার একদিনে ডেঙ্গুতে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছিল, যা চলতি বছর একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু হিসেবে রেকর্ড করা হয়।
ডেঙ্গুর বর্তমান পরিসংখ্যান:
২০২৫ সালের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত, দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট ১৯২ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে, ৪৬,০৫১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এডিস মশার বৃদ্ধি এবং গ্রীষ্মকালীন বৃষ্টিপাতের কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে।
ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর হটস্পট
ঢাকা মহানগর ডেঙ্গুর প্রধান কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ ও উত্তরা অংশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রিপোর্ট অনুযায়ী, ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০০-এর বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করছেন:
- পানি জমে থাকা: শহরের বিভিন্ন এলাকা, খালি প্লট, নির্মাণাধীন ভবন ও অপরিষ্কার নালায় পানি জমে থাকা।
- সচেতনতার অভাব: মশার লার্ভা নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়া।
- আবহাওয়া পরিবর্তন: হঠাৎ বৃষ্টি ও আর্দ্র পরিবেশ মশার বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করছে।
ডেঙ্গু সংক্রান্ত জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু ওয়ার্ড সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এছাড়া, অতিরিক্ত সেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যকর্মীদের পর্যাপ্ত রেশিও ও ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
ডেঙ্গু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানাচ্ছেন, “ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধু চিকিৎসা নয়, জনগণের সচেতনতা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। লার্ভা নিধন অভিযান, পানি জমা না রাখা, মশারি ব্যবহার এবং গৃহস্থলীতে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখাটা এখন সময়ের দাবি।”
ডা. আয়েশা রহমান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ বলেন, “প্রতি বছর গ্রীষ্ম ও বর্ষার সময় ডেঙ্গু বৃদ্ধি পায়। তবে, সম্প্রতি ঢাকায় রোগীর সংখ্যা অভাবনীয়ভাবে বেড়েছে। মানুষকে এখনই সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও কমজোর মানুষদের সতর্ক থাকতে হবে। ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণ দেখলে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া জরুরি।”
ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণ ও সতর্কতা
ডেঙ্গু সাধারণত এডিস মশা দ্বারা সংক্রমিত হয়। রোগী প্রাথমিকভাবে জ্বর, মাথাব্যথা, চোখে ব্যথা, বমি বা ক্লান্তি অনুভব করতে পারেন। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা:
- বাড়ির চারপাশে পানি জমতে দেবেন না।
- পানি ধরে রাখার পাত্র ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখুন।
- মশার লার্ভা ধ্বংস করার জন্য লার্ভিসাইড ব্যবহার করুন।
- রাতে মশারি ব্যবহার করুন বা রেপেলেন্ট ক্রিম লাগান।
- জ্বর ও শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিলে দ্রুত নজর দেওয়ার জন্য হাসপাতালে যান।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেন, ডেঙ্গুর হেমোরেজিক বা সিরিয়াস ধরণের ক্ষেত্রে জীবনহানি ঘটতে পারে। তাই প্রাথমিক লক্ষণ দেখা মাত্রই চিকিৎসা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
অন্যান্য বিভাগের অবস্থা
ঢাকার বাইরে, দেশের বিভিন্ন বিভাগেও ডেঙ্গু প্রভাব বিস্তার করছে।
- বরিশাল: ১৬৬ জন ভর্তি, শহরের পানি নালায় মশার লার্ভা বৃদ্ধি পেয়েছে।
- চট্টগ্রাম: ৯১ জন ভর্তি, স্বাস্থ্য বিভাগ লার্ভা নিধনে সচেষ্ট।
- খুলনা: ১০১ জন ভর্তি, বিশেষ করে নদী ও খালপাড়ের আশেপাশে জল জমে আছে।
- রাজশাহী ও ময়মনসিংহ: কমসংখ্যক রোগী হলেও, স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি লার্ভা ধ্বংস অভিযান চালাচ্ছেন।
সরকারের উদ্যোগ
সরকার ডেঙ্গু মোকাবিলায় বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে।
- ঢাকার প্রতিটি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ডেঙ্গু ওয়ার্ড সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
- স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং স্থানীয় প্রশাসন যৌথভাবে লার্ভা ধ্বংস অভিযান চালাচ্ছে।
- টেলিভিশন, রেডিও ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার প্রচারণা চলছে।
- গৃহস্থালী মশারি, রেপেলেন্ট ও পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার জন্য নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
মানুষের প্রতিক্রিয়া
ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ আতঙ্কিত। মোহাম্মদ আলী, একটি স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “প্রতিদিন আমরা দেখি হাসপাতাল ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এখন পরিবারের সব সদস্যকে সাবধানে রাখা জরুরি। শিশু ও বৃদ্ধদের বাইরে না বের করার চেষ্টা করছি।”
অন্যান্য মানুষ সচেতনতা বৃদ্ধি ও সরকারি নির্দেশনা মেনে চলার ওপর জোর দিচ্ছেন। বিশেষ করে গৃহস্থালী পানি জমে না রাখার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছেন।
ডেঙ্গু মোকাবিলার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ:
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা।
- পানি জমা না রাখা ও লার্ভা ধ্বংস করা।
- মশার উপদ্রব কমাতে মশারি ও রেপেলেন্ট ব্যবহার।
- ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণ দেখা মাত্রই চিকিৎসা গ্রহণ।
- শিশু, বৃদ্ধ ও রোগপ্রবণদের বিশেষ সতর্কতা।
- সরকারি সচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু শুধুমাত্র চিকিৎসা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এটি মোকাবিলা করতে হবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, সচেতনতা এবং জনগণের সহযোগিতার মাধ্যমে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। একদিনে ৪ জনের মৃত্যু এবং ৮৪৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আমাদের সতর্ক করতে 충분। প্রতিটি নাগরিককে অবশ্যই সচেতন হতে হবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে এবং প্রয়োজন হলে চিকিৎসা নিতে দেরি করা যাবে না।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে শুধু সরকারের পদক্ষেপ নয়, আমাদের প্রতিটি নাগরিকের সচেতনতা জরুরি। সময়মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করলে, আমরা এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি এবং আরও প্রাণহানি রোধ করতে পারি।
MAH – 13056 I Signalbd.com



