
মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবা বা নিগ্লেরিয়া ফাউলেরি (Naegleria fowleri) একটি বিরল, কিন্তু অত্যন্ত মারাত্মক পরজীবী। এটি মানুষের মস্তিষ্কে সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম এবং প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশের মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে প্রাণহানির ঘটনা ঘটাতে পারে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানিয়েছেন যে, এই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণহীন থাকলে মৃত্যুহার ৯৬–৯৮ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
ডা. কাকলী হালদার, সহকারী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মতে, এই অ্যামিবা সাধারণত উষ্ণ মিঠাপানি, পুকুর, হ্রদ, নদী এবং অপরিষ্কার সুইমিংপুলে বাস করে। “যেখানে পানির তাপমাত্রা বেশি এবং ক্লোরিন ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো নেই, সেখানে এই পরজীবীর সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি,” তিনি বলেন।
বিশ্বে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি
বিশেষ করে ভারতের কেরালা রাজ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবা সংক্রমণের কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই খবরগুলো জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুসারে, এই সংক্রমণ খুবই বিরল, কিন্তু যেসব অঞ্চলে উষ্ণ ও অপরিষ্কার পানি প্রচুর, সেখানে সতর্ক থাকা জরুরি।
বাংলাদেশেও এই সংক্রমণ সম্পূর্ণ অচেনা নয়। ২০১৮ সালে দেশের প্রথম স্বীকৃত রোগী হিসেবে ১৫ বছরের এক কিশোরকে শনাক্ত করা হয়েছিল, যিনি ব্রেন ইটিং অ্যামিবায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।幸
সংক্রমণ কীভাবে ঘটে
মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবা সাধারণত নাকের মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটায়। সংক্রামিত পানি নাকে প্রবেশ করলে অ্যামিবা ঘ্রাণ স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে। এটি সরাসরি পানি পান করার মাধ্যমে বা একজন থেকে আরেকজনের সংস্পর্শে হাঁচি, কাশি বা স্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায় না।
ডা. কাকলী হালদারের মতে, “এটি একটি দ্রুতগতির সংক্রমণ। একবার মস্তিষ্কে প্রবেশ করলে রোগীর অবস্থার অবনতি খুব দ্রুত ঘটে। তাই প্রাথমিক সতর্কতা গ্রহণ করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
লক্ষণসমূহ
সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে দেখা দেয়:
- তীব্র মাথাব্যথা
- জ্বর
- বমি
- ঘাড়ের শক্ত হয়ে যাওয়া
পরবর্তী পর্যায়ে সংক্রমণ ছড়ালে রোগীর মধ্যে দেখা দিতে পারে:
- খিঁচুনি বা জ্ঞানহীনতা
- ভারসাম্যহীনতা এবং চলাফেরার সমস্যা
- হ্যালুসিনেশন বা বিভ্রান্তি
- ঘ্রাণ বা দৃষ্টি সংক্রান্ত সমস্যা
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা কোমা
চিকিৎসা না হলে রোগীর মৃত্যু কয়েক দিনের মধ্যে ঘটতে পারে।
চিকিৎসা পদ্ধতি
যদিও সংক্রমণ মারাত্মক, তবে কিছু ক্ষেত্রে অ্যান্টিফাঙ্গাল ও অ্যান্টিবায়োটিকের যৌথ প্রয়োগে রোগী সুস্থ হতে পারেন। সাধারণত ব্যবহৃত ওষুধ:
- অ্যামফোটেরিসিন বি (Amphotericin B)
- মিল্টেফোসাইন (Miltefosine)
- ফ্লুকোনাজোল (Fluconazole)
- রিফাম্পিন (Rifampin)
ডা. কাকলী হালদারের পরামর্শ, “সবচেয়ে বড় ভরসা হলো দ্রুত শনাক্তকরণ এবং প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করা। রোগীর জীবনের জন্য এটি অত্যন্ত জরুরি।”
প্রতিরোধ ও সাবধানতা
বিশেষজ্ঞরা নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন:
- অপরিচিত বা অপরিষ্কার উষ্ণ পানিতে সাঁতার না কাটা।
- নাকের মাধ্যমে পানি প্রবেশ এড়াতে নাক ক্লিপ ব্যবহার বা হাত দিয়ে নাক বন্ধ রাখা।
- নাক পরিষ্কারের জন্য ফিল্টার করা বা ফুটানো পানি ব্যবহার করা।
- সুইমিংপুলে নিয়মিত পরিমাণমতো ক্লোরিন দেওয়া।
- উষ্ণ মিঠাপানি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশে ঝুঁকি ও ভবিষ্যৎ প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশের উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া, অপরিষ্কার জলাশয়, এবং বিভিন্ন কাজের জন্য অপরিষ্কার পানির ব্যবহার এই সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। যদিও এখনো দেশটিতে এই সংক্রমণ বিরল, জলবায়ু পরিবর্তন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ভবিষ্যতে ঝুঁকি আরও বেড়ে যেতে পারে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করান, সচেতনতা, নিরাপদ পানি ব্যবহার এবং পরিচ্ছন্ন সাঁতার সুবিধা থাকলেই এই মারাত্মক সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ
যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ব্রেন ইটিং অ্যামিবা সংক্রমণ সাধারণত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ঘটে, যখন পানি উষ্ণ থাকে। যেকোনো অপরিচ্ছন্ন পানি, যেখানে ক্লোরিন ব্যবস্থাপনা যথাযথ নয়, সেখানে সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি।
বিশেষজ্ঞরা আবারও সতর্ক করেছেন, “যত দ্রুত রোগ শনাক্ত হয় এবং চিকিৎসা শুরু হয়, রোগীর বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। তাই জনসচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি।”
মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবা সংক্রমণ একটি দূর্লভ কিন্তু প্রাণঘাতী স্বাস্থ্যঝুঁকি, যা প্রাথমিক সতর্কতা, পরিচ্ছন্ন পানি ব্যবহার এবং সচেতনতার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশে এখনো সংক্রমণ খুব কম হলেও উষ্ণ জলাশয়, সাঁতার সুবিধা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে ভবিষ্যতে এর ঝুঁকি বাড়তে পারে। জনসাধারণের উচিত অপরিচিত উষ্ণ পানিতে সাঁতার না কাটা, নাক রক্ষা করা এবং নিরাপদ পানি ব্যবহার নিশ্চিত করা।
MAH – 12945 I Signalbd.com