কলমবিরতিতে সারা দেশে আমদানি কার্যক্রম বিঘ্নিত

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা–কর্মচারীদের কলমবিরতি কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে বৃহস্পতিবার (১৫ মে ২০২৫) দেশের আমদানি বাণিজ্যসহ রাজস্ব খাতের কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, এবং যশোরের বেনাপোলসহ দেশের প্রধান কাস্টম হাউস এবং শুল্ক-কর কার্যালয়গুলোতে কাজ প্রায় বন্ধ ছিল। এর ফলে আমদানি-সংক্রান্ত ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপক ভোগান্তি দেখা দিয়েছে। এই কর্মসূচি এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশের প্রতিবাদে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে পালিত হচ্ছে।
কলমবিরতির প্রভাব
কলমবিরতি কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন কাস্টম হাউস এবং শুল্ক-কর কার্যালয়ে কাজ বন্ধ ছিল। এই সময়ে আমদানি পণ্যের শুল্কায়ন, পরীক্ষণ, এবং খালাস কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে স্থগিত ছিল। ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত এনবিআরের প্রধান কার্যালয়সহ রাজধানীর বিভিন্ন কর অঞ্চল, যেমন কর অঞ্চল-২, ১০, ১৬, এবং ২৪, এবং মুন্সিগঞ্জের শুল্ক ও ভ্যাট কার্যালয়ে কোনো কাজ হয়নি। এছাড়া, ঢাকা বিমানবন্দর এলাকার কাস্টম হাউসেও আমদানি কার্যক্রম বন্ধ ছিল।
চট্টগ্রাম বন্দরে পরিস্থিতি আরও জটিল ছিল। সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে আমদানি-সংক্রান্ত কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বন্দরে পণ্য খালাস কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়। এর সঙ্গে সকাল ৬টা থেকে কনটেইনারবাহী গাড়িচালক ও শ্রমিকদের পৃথক কর্মবিরতি পণ্য পরিবহন কার্যক্রমকে আরও বাধাগ্রস্ত করে। ফলে দিনভর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের কনটেইনার পরিবহন কার্যত বন্ধ ছিল। বিকেল সাড়ে ৪টায় শ্রমিকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহারের পর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে কনটেইনার পরিবহন কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়।
যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরে পরিস্থিতি ছিল আরও নাজুক। কলমবিরতির কারণে ভারতের পেট্রাপোল বন্দর থেকে আমদানি পণ্য নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশকারী ট্রাকের সংখ্যা শূন্য ছিল। দুপুর পর্যন্ত প্রায় ৪৫০টি ট্রাক পেট্রাপোল বন্দরে অপেক্ষমাণ ছিল। বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. কামরুজ্জামান জানান, পণ্যের জট এড়াতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে, বেলা ৩টার পর সীমিত পরিসরে কাজ শুরু হলেও আমদানি কার্যক্রমে স্বাভাবিক গতি ফিরে আসেনি।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের দাবি
কলমবিরতি কর্মসূচির পেছনে মূল কারণ হলো গত সোমবার (১২ মে ২০২৫) রাতে জারি করা ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে এনবিআর এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) বিলুপ্ত করে ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ এবং ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ নামে দুটি নতুন বিভাগ গঠন করা হয়েছে। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ এই অধ্যাদেশকে রাজস্ব ব্যবস্থার দক্ষতা ও গতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ তিন দফা দাবি উত্থাপন করে: ১. রাজস্ব অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল করা। ২. এনবিআর সংস্কার-সংক্রান্ত পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা। ৩. এনবিআর, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, এবং রাজনৈতিক নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার করা।
সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কর কমিশনার সিফাত ই মরিয়ম এবং উপ-কর কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান বক্তব্য দেন। তারা জানান, আগামী শনিবার (১৭ মে ২২০৫) সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত কলমবিরতি কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। ঈদের ছুটি সমন্বয়ের জন্য সরকারি নির্দেশে শনিবার সব অফিস খোলা থাকবে, এবং এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই দিনেও কর্মসূচি পালন করবেন।
ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি
কলমবিরতির কারণে আমদানি বাণিজ্যে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বেনাপোল ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্ট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান জানান, বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিদিন ৪০০-৪৫০ ট্রাক পণ্য আমদানি হয়। কিন্তু কর্মদিবসের ছয় ঘণ্টা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় পণ্যের জট সৃষ্টি হচ্ছে। এটি ব্যবসায়ীদের জন্য বাড়তি খরচ এবং সময়ের অপচয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি পণ্য খালাসে বিলম্বের কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বন্দরে কনটেইনার জটের সমস্যা আরও প্রকট হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া, সিলেট, রংপুর, এবং কক্সবাজারের শুল্ক ও কর কার্যালয়গুলোতেও কলমবিরতি পালিত হওয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ভোগান্তির মুখে পড়েছেন।
সরকারি প্রতিক্রিয়া
এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা বেলা ২টার দিকে সাংবাদিকদের হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়ে জানান, এনবিআর চেয়ারম্যান এই ইস্যুতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান পরে সাংবাদিকদের এড়িয়ে যান। এদিকে, দুপুরের পর থেকে এনবিআর ভবনে বহিরাগত ব্যক্তিদের আনাগোনা লক্ষ্য করা গেছে, যা পরিস্থিতির জটিলতা আরও বাড়িয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছেন, নতুন অধ্যাদেশে সবার স্বার্থ সংরক্ষিত আছে। তবে, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, অধ্যাদেশের খসড়ায় তাদের মতামত প্রতিফলিত হয়নি। এছাড়া, রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞতাহীন কর্মকর্তাদের পদায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে, যা রাজস্ব ব্যবস্থার দক্ষতা ও গতিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ জানিয়েছে, শনিবারের কর্মসূচির পর তারা নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে। কর্মকর্তারা সংস্কারের পক্ষে থাকলেও তারা চান, সংস্কার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ এবং সব অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে হোক। তারা অভিযোগ করেছেন, বর্তমান অধ্যাদেশ রাজস্ব ব্যবস্থাকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে ফেলবে এবং এনবিআরের কার্যকারিতা ক্ষুণ্ন করবে।
উপসংহার
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কলমবিরতি কর্মসূচি দেশের আমদানি বাণিজ্য এবং রাজস্ব খাতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি আরও বাড়বে এবং অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। সরকার এবং এনবিআর কর্মকর্তাদের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান জরুরি হয়ে পড়েছে। সংস্কারের নামে রাজস্ব ব্যবস্থার কার্যকারিতা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে সব পক্ষের সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।