অর্থনীতি

২০২৩ সালে কর ফাঁকিতে দেশের রাজস্ব ক্ষতি ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা

২০২৩ সালে বাংলাদেশ সরকার কর ফাঁকির কারণে প্রায় ২ লাখ ২৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর এক সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। রাজধানীর ধানমন্ডিতে অবস্থিত সিপিডির কার্যালয়ে গত সোমবার আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে ‘করপোরেট আয়কর সংস্কার ও কর ন্যায্যতার দৃষ্টিকোণ’ শীর্ষক গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়।

সিপিডির গবেষণাটি দেশের বর্তমান কর ব্যবস্থার দুর্বলতা, উচ্চ কর হার, কর প্রশাসনের দুর্নীতি এবং কর ফাঁকির বিরূপ প্রভাব নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে। গবেষণায় উঠে আসে, একদিকে যখন কিছু প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে, তখন অনেক সৎ করদাতা নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন।

রাজস্ব ক্ষতির বিশ্লেষণ

গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৩ সালে কর ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ২৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বিশাল নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ ধরণের রাজস্ব ক্ষতি শুধু অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নয়, বরং ন্যায়বিচারভিত্তিক কর ব্যবস্থার উপরও প্রশ্ন তোলে।

এ প্রসঙ্গে সিপিডির গবেষকরা জানান, “এই বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকির অর্থ দিয়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামো খাতে বিশাল উন্নয়ন সম্ভব ছিল। অথচ কর আদায়ের দুর্বলতা এবং অব্যবস্থাপনার কারণে তা হচ্ছে না।”

কর প্রশাসনে ঘুষ ও হয়রানির অভিযোগ

গবেষণায় অংশ নেওয়া ৪৫ শতাংশ কোম্পানি সরাসরি অভিযোগ করেছে যে, কর দেওয়ার সময় তাদেরকে ঘুষের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এমন পরিস্থিতি শুধু কর আদায়ের ন্যায্যতা নষ্ট করছে না, বরং সৎ ব্যবসায়িক পরিবেশের জন্যও হুমকি সৃষ্টি করছে।

এছাড়া ৮২ শতাংশ কোম্পানি মনে করছে, বর্তমানে প্রযোজ্য কর হার অযৌক্তিক এবং ব্যবসার প্রসারে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তারা কর ব্যবস্থায় সংস্কার এবং নীতিগত স্বচ্ছতা আনার দাবি জানিয়েছে।


কর ফাঁকির ইতিহাস ও ধারা

সিপিডি গবেষণায় আরও বলা হয়েছে যে, কর ফাঁকির প্রবণতা বাংলাদেশে নতুন নয়। ২০১১ সাল থেকে এটি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। যেমন:

  • ২০১২ সালে কর ফাঁকির পরিমাণ ছিল ৯৬ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা
  • ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৩ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা
  • ২০২৩ সালে তা দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ২৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা

এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে যে, সময়ের সাথে কর ফাঁকি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে গভীর প্রভাব ফেলছে।


কর ফাঁকির পেছনের কারণসমূহ

সিপিডির গবেষণায় কয়েকটি মূল কারণকে চিহ্নিত করা হয়েছে যেগুলোর জন্য কর ফাঁকির প্রবণতা বেড়ে চলেছে:

  1. উচ্চ কর হার: অধিক কর হার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর ফাঁকিতে উৎসাহিত করছে।
  2. প্রশাসনিক দুর্বলতা: কর আদায়ের প্রক্রিয়ায় দক্ষতা ও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে।
  3. জটিল আইনি কাঠামো: কর আইন এতটাই জটিল যে, সাধারণ ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠান সহজে তা বুঝতে পারে না।
  4. দুর্নীতি: কর কর্মকর্তাদের একটি অংশ ঘুষ ও হয়রানির মাধ্যমে করদাতাদের নিরুৎসাহিত করছে।

সৎ করদাতাদের ওপর চাপ

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, কর ফাঁকির কারণে যে রাজস্ব ঘাটতি তৈরি হয় তা পূরণ করতে সরকার সৎ করদাতাদের ওপর অধিক চাপ প্রয়োগ করে। ফলে একটি বৈষম্যমূলক কর ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের ব্যবসা পরিবেশকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।

এ প্রসঙ্গে সিপিডির একজন সিনিয়র গবেষক বলেন, “যারা নিয়ম মেনে কর দেয়, তাদেরকেই বেশি চাপে পড়তে হয়। অন্যদিকে যারা কর ফাঁকি দেয়, তারা অনেক সময় লাভবান হয়। এভাবে কর ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে।”

উত্তরণকালীন কর ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশ বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণে রয়েছে। এই উত্তরণের ফলে বহুজাতিক কোম্পানি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য দেশের অর্থনৈতিক পরিসর উন্মুক্ত হচ্ছে। কিন্তু কর ব্যবস্থার এই দুর্বলতা ও ফাঁকি সমস্যার সমাধান না করা হলে, ভবিষ্যতে কর ফাঁকির সুযোগ আরও বেড়ে যেতে পারে।

সিপিডি মনে করে, কর ফাঁকির এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। এর মধ্যে কর প্রশাসনের স্বচ্ছতা, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, স্বল্প কর হার নির্ধারণ ও করদাতাদের সুরক্ষার বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পেতে হবে।

সুপারিশ ও কর সংস্কারের পথ

সিপিডি তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে সরকার ও নীতিনির্ধারকদের জন্য কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে:

  • কর প্রশাসনের ডিজিটালাইজেশন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা
  • কর কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা বাড়ানো
  • কর হার যৌক্তিক ও বিনিয়োগবান্ধব পর্যায়ে আনা
  • কর আইনের সরলীকরণ
  • করদাতাদের তথ্য গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা

উপসংহার

বাংলাদেশের জন্য কর ফাঁকি একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হলেও এখন এটি একটি জাতীয় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। দেশ যখন উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন কর ব্যবস্থার দুর্বলতা ও দুর্নীতি সেই অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। সিপিডির এই গবেষণা শুধু একটি সতর্কবার্তাই নয়, বরং কর ন্যায্যতা ও অর্থনৈতিক জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি কার্যকর রোডম্যাপ।

যদি সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মহল এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়, তাহলে রাজস্ব ঘাটতি কমিয়ে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত করা সম্ভব হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button