বাংলাদেশ

দেশজুড়ে গণপিটুনির অভিশাপ: মাত্র ১০ দিনে নিহত ৯ জন

Advertisement

বাংলাদেশে চলতি আগস্ট মাসের প্রথম ১০ দিনে একের পর এক গণপিটুনির ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ ও মানবাধিকার সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, এ সময়ে অন্তত ১৩টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৯ জন নিহত এবং ১৩ জন আহত হয়েছেন।

একদিকে চোর সন্দেহে নিরীহ মানুষের উপর দমবন্ধ করা গণপিটুনি, অন্যদিকে সামাজিক অস্থিরতার কারণ হয়ে উঠেছে ‘মব সন্ত্রাস’। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে জনজীবনে রয়েছে ব্যাপক উদ্বেগ ও আশঙ্কা।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে: বর্বর গণপিটুনিতে নিহত ৮৭, আহত ২৬৬

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএফএস) জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৭৮ জন। আগস্টের প্রথম ১০ দিনের ঘটনার পর এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৭ জনে। একই সময়ে আহত হয়েছেন ২৬৬ জন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শুরু থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত অন্তত ১১১ জন মানুষ মব সন্ত্রাসের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।

সর্বশেষ: রংপুর ও মাদারীপুরে নির্মম গণপিটুনি ও হত্যাকাণ্ড

সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো ৯ আগস্টের রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় ঘটে যাওয়া বর্বরতা। চোর সন্দেহে দুইজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতদের নাম রূপলাল দাস ও প্রদীপ দাস।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, রূপলাল ও প্রদীপ ছিলেন জামাই ও শ্বশুর; তারা বাড়ি ফেরার পথে ভ্যানচোর সন্দেহে আক্রান্ত হন। নিহত রূপলালের মা লালিচা দাস বলেন, তার ছেলে চোর নয়, তিনি জুতা সেলাই করে সংসার চালান।

একই দিনে মাদারীপুরে চোর সন্দেহে তিনজনকে গণপিটুনির শিকার করা হয়, যার এক ব্যক্তির চোখ তুলে ফেলার চেষ্টা করা হয়।

পুলিশের দুর্বলতা, বিচারহীনতা আর মব সন্ত্রাসের অন্ধকার

জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে পুলিশি কার্যক্রম দুর্বল হওয়ায় দেশে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই বেড়ে গেছে। একদিকে অপরাধ বেড়েছে, অন্যদিকে বিচারহীনতা এই ধরনের গণপিটুনির ঘটনাকে উৎসাহিত করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলছেন, “যখন বিচারহীনতা বাড়ে, তখন মানুষও সহিংস হয়ে ওঠে। অভ্যুত্থানের পর থেকে তাৎক্ষণিক মব ও সংঘবদ্ধ মবের ঘটনা বেড়েছে, যেখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও লুকানো থাকে।”

গণপিটুনির কারণ: চোর সন্দেহ, চাঁদাবাজি, বিরোধ ও পূর্বশত্রুতা

আগস্টের প্রথম ১০ দিনে ১৩টি গণপিটুনির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৮টি ঘটনাই চোর সন্দেহে সংঘটিত হয়েছে। বাকি পাঁচটি ঘটনার মধ্যে রয়েছে চাঁদাবাজি, পূর্বশত্রুতা ও ব্যক্তিগত বিরোধ।

মানবাধিকার কর্মীরা মনে করছেন, সরকারের কার্যকর উদ্যোগের অভাবেই এই ধরনের মব সন্ত্রাস থামছে না।

জরিপে উঠে এসেছে মব সন্ত্রাস নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ

বিআইজিডির ‘পালস সার্ভে ৩’ শিরোনামের একটি জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ মব সহিংসতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। নারীর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ৫৬%, রাতে চলাচলের নিরাপত্তায় ৬১%, আর পোশাকের কারণে রাস্তায় হয়রানি নিয়ে ৬৭% মানুষ উদ্বিগ্ন।

এই জরিপ ২০২৫ সালের আগস্টে প্রকাশিত হয়েছে এবং দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির বেদনাদায়ক ছবি তুলে ধরেছে।

সরকারের প্রতিক্রিয়া: পুলিশের মোরাল সংকট ও দমনে বাধা

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল গত ১ আগস্ট এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “মব সন্ত্রাস দমনে সবচেয়ে বড় সমস্যা পুলিশের নৈতিক সংকট। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুলিশ গণ-অভ্যুত্থানের বিরোধী ছিল, এখন যারা মব করছে তাদের মোকাবিলা করতে পারছে না।”

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, সরকারের দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই, তাই গণপিটুনি ও মব সন্ত্রাস থামছে না।

মানবাধিকার কর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গি: রাজনৈতিক প্রভাব ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি

গুম তদন্ত কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন বলেন, “সরকার থেকে দৃশ্যমান কোনো শক্তিশালী পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। অনেক সময় বিভ্রান্তিতে ভুগছে প্রশাসন। মানুষ সরকারের ওপর আস্থা হারাচ্ছে।”

তিনি আরও জানান, মব সন্ত্রাসের পেছনে রাজনৈতিক কিছু দুর্বৃত্তদেরও ভূমিকা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালত পর্যন্ত মব ভীতি কাজ করছে, যার ফলে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

কী করণীয়?

বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক দূর্নীতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে দেশে মব সন্ত্রাসের ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উচিত দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া—

  • মব সন্ত্রাস দমনে কঠোর আইন প্রয়োগ
  • পুলিশের নৈতিক ও পেশাগত মান উন্নয়ন
  • গণপিটুনির ঘটনায় দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত
  • জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও সমাজে শান্তি স্থাপন

গণপিটুনি ও মব সন্ত্রাস এখন বাংলাদেশের বড় এক সামাজিক ও নিরাপত্তাজনিত সংকট। মানুষের নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকারের জন্য এটি বিরাট হুমকি। আগামী দিনে এই সংকট থেকে উত্তরণে সরকারের দৃঢ় ও দায়িত্বশীল পদক্ষেপ ছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন।

MAH – 12266 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button