অর্থনীতি

স্থলপথে সুতা বন্ধ, দেশীয় কারখানাগুলোর স্বস্তি ফিরেছে

বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাকশিল্প খাত দীর্ঘদিন ধরেই দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। এই খাতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ও দেশীয় সুতা উৎপাদন খাতকে রক্ষা করতে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানির সুবিধা বাতিল করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করেছে এনবিআর, যা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়েছে।

কোন কোন বন্দর দিয়ে আমদানি বন্ধ?

এই নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এখন থেকে বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা ও বুড়িমারী—এই পাঁচটি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকবে। তবে সমুদ্রপথ বা অন্য কোনো বিকল্প পথে সুতা আমদানির অনুমতি বহাল থাকবে। অর্থাৎ, চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে সুতা আনা যাবে, তবে সীমান্তবর্তী স্থলবন্দরগুলোতে আর এই সুযোগ থাকবে না।

পূর্বের নীতির পরিবর্তন

২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট জারি করা একটি প্রজ্ঞাপন সংশোধন করে আজকের এই নতুন প্রজ্ঞাপনটি প্রকাশ করা হয়। এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা আল-আমিন শেখ আজকের পত্রিকাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এবং জানিয়েছেন, “এই আদেশ আজ থেকেই কার্যকর করা হয়েছে।” এর ফলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবিলম্বে নীতি পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিটিএমএ ও ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশেই এই সিদ্ধান্ত

এই সিদ্ধান্তের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন

২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিটিএমএ একটি আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করে যাতে স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধের আহ্বান জানানো হয়। তাদের যুক্তি ছিল, ভারতীয় সুতা কম দামে বাজারে প্রবেশ করে দেশের সুতা উৎপাদনকারীদের প্রতিযোগিতার বাইরে ঠেলে দিচ্ছে।

পরবর্তী সময়ে মার্চ মাসে ট্যারিফ কমিশন থেকে এনবিআর চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি পাঠিয়ে দেশীয় সুতার ব্যবহার বাড়ানো ও দেশীয় শিল্প রক্ষার লক্ষ্যে স্থলপথে সুতা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির আহ্বান জানানো হয়। সেই সঙ্গে প্রস্তাব রাখা হয়, যতক্ষণ না সীমান্ত সংলগ্ন কাস্টমস ও স্থলবন্দরগুলোতে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সুতা কাউন্ট নির্ধারণ ও যাচাইয়ের অবকাঠামো তৈরি হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সমুদ্রপথেই সুতা আমদানির অনুমোদন বহাল রাখা হোক।

কেন এই সিদ্ধান্ত জরুরি ছিল?

১. সস্তা ভারতীয় সুতায় দেশি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত

টেক্সটাইল শিল্প মালিকদের দাবি, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপাদিত সুতা কলকাতায় গুদামজাত করে সেখান থেকে তা স্থলবন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এই সুতাগুলোর দাম তুলনামূলকভাবে অনেক কম হওয়ায় বাংলাদেশের পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো তা ব্যাপকহারে আমদানি করছে।

ফলে দেশীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদিত সুতা বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। এমনকি চীন, তুরস্ক, উজবেকিস্তানসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা সুতার সঙ্গে দেশি সুতার দাম প্রতিযোগিতামূলক হলেও, ভারতীয় সুতার দাম অনেক কম হওয়ায় বিপণনে মার খাচ্ছে দেশীয় মিলগুলো

২. ঘোষিত দামের চেয়ে কম দামে প্রবেশ

বিটিএমএ-র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম কাস্টমসে ঘোষিত দামের চেয়ে ভারতীয় সুতা স্থলবন্দরের মাধ্যমে অনেক কম দামে দেশে প্রবেশ করছে। এতে কাস্টমস রাজস্ব হারাচ্ছে এবং একই সঙ্গে দেশে অবৈধভাবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে পণ্য প্রবেশের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। ফলে সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে এবং দেশীয় শিল্পের জন্য এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে একধরনের বৈষম্যমূলক পরিস্থিতি।

শিল্প মালিকদের প্রতিক্রিয়া

বিটিএমএ সভাপতি ও অন্যান্য টেক্সটাইল মিল মালিকরা এনবিআরের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, “এই সিদ্ধান্ত দেশের সুতাশিল্পকে একটি সময়োপযোগী সুরক্ষা দেবে। দীর্ঘদিন ধরেই আমরা ভারতীয় সুতার দামের কারণে উৎপাদনে সংকটের মুখে ছিলাম।”

তবে একই সঙ্গে তাঁরা আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন যে, এই সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সমুদ্রপথেও শুল্ক ফাঁকি দিতে পারে। তাই কাস্টমস হাউসগুলোতে সুতা কাউন্ট, মান যাচাই ও শুল্কমূল্য নির্ধারণে আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে

ভোক্তা পর্যায়ে প্রভাব পড়বে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, স্থলপথে আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় স্বল্প-মেয়াদে সুতা ও কাপড়ের বাজারে কিছুটা অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। কারণ, যেসব পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ভারতীয় সুতা আমদানির উপর নির্ভর করছিল, তাদের উৎপাদন খরচ সাময়িকভাবে বেড়ে যেতে পারে।

তবে দীর্ঘমেয়াদে এই সিদ্ধান্ত দেশীয় উৎপাদনকারীদের সক্ষমতা বাড়াবে এবং ভোক্তাদের জন্য মানসম্পন্ন দেশীয় পণ্য নিশ্চিত করবে

সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান জানিয়েছেন, সরকার এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে একাধিক স্তরে কাজ করবে। সীমান্তবর্তী কাস্টমস হাউসগুলোতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, স্ক্যানিং সুবিধা, কাউন্ট পরীক্ষার ব্যবস্থা ও ডিউটি নির্ধারণের নতুন মডেল চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর ফলে ভবিষ্যতে যদি স্থলপথে আমদানি খোলাও হয়, তখন তা অস্বচ্ছ ও শুল্ক ফাঁকির পথ হয়ে উঠবে না

বাংলাদেশে সুতা ও বস্ত্র খাতে প্রতিযোগিতার ভারসাম্য বজায় রাখতে এনবিআরের এই সিদ্ধান্ত একটি সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ করে দেশের বিপুল সম্ভাবনাময় টেক্সটাইল খাতকে নতুন করে চাঙ্গা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

অবশ্যই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রয়োজন হবে কঠোর নজরদারি, শুল্ক পর্যালোচনা ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো উন্নয়ন। সেই সঙ্গে সমুদ্রপথেও যাতে শুল্ক ফাঁকি না দেওয়া যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে কাস্টমস ও এনবিআরকে।

এখন দেখার বিষয় হলো, সরকার কীভাবে দেশের টেক্সটাইল শিল্পকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলতে পারে এবং এই নিষেধাজ্ঞাকে শিল্প পুনর্জাগরণের সুযোগে রূপ দিতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button