টিকল না আইসিবি ব্যাংক, হস্তক্ষেপ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের

বিদেশি বিনিয়োগ, বারবার নাম পরিবর্তন, আদালতের মামলায় জড়িয়ে থাকা—সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত হলো আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। নিয়ন্ত্রণ নিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০০৭ সালে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ICB Financial Group বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের ৫৩ শতাংশ শেয়ার কিনে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করলেও সফল হতে পারেনি। ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি পায়নি বিদেশি এই গ্রুপটি। আইনি জটিলতা ও মামলা-মোকদ্দমায় আটকে পড়ে ব্যাংকটি ধীরে ধীরে আর্থিকভাবে দুর্বল হতে থাকে।
আইনি জটিলতায় আটকে বিদেশি বিনিয়োগ
ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের মালিকানা বদলের পরপরই বিনিয়োগকারীদের করা একাধিক মামলায় আদালত স্থিতাবস্থা জারি করেন, যার ফলে ICB Financial Group ব্যাংকের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ২০০৮ সালে ব্যাংকটির নাম বদলে রাখা হয় আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ আগ্রহ নিয়ে বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু আইনগত সীমাবদ্ধতায় তারা নিয়ন্ত্রণ পায়নি। এ ধরনের জটিলতা দূর না করলে ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে আগ্রহ হারাবে।”
দীর্ঘ ইতিহাস: আল-বারাকা থেকে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক
ব্যাংকটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮৭ সালে, আল-বারাকা ব্যাংক হিসেবে। ১৯৯৪ সালে এটিকে “সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এরপর ২০০৪ সালে নাম বদলে চালু হয় ওরিয়েন্টাল ব্যাংক নামে।
২০০৬ সালে ব্যাপক অনিয়মের কারণে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ২০০৭ সালে নতুন শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে নিলামে তুলে দেওয়া হয় ব্যাংকটি। সেখান থেকেই ICB Financial Group অংশীদার হয়ে ব্যাংকটি পরিচালনার দায়িত্ব নেয়।
অব্যবস্থাপনা, খেলাপি ঋণ আর্থিক বিপর্যয়ের মূল কারণ
ব্যাংকটির বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল।
- ২০২৪ সালে দেওয়া ৭৪১ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ৯১% অর্থাৎ ৬৭২ কোটি টাকা খেলাপি।
- ২০২৩ সালে লোকসান হয়েছে ৫৬ কোটি টাকা।
- ব্যাংকটির শেয়ারমূল্য পড়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ টাকা ৯০ পয়সা, যা ১০ টাকার অভিহিত মূল্যের তুলনায় অনেক নিচে।
পর্ষদ ভেঙে দিল বাংলাদেশ ব্যাংক
২০২৫ সালের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে:
“পর্ষদের দুর্বলতার কারণে মূলধন ঘাটতি, শ্রেণিকৃত বিনিয়োগ, পূঞ্জীভূত ক্ষতি এবং তারল্য সংকট চরমে পৌঁছেছে। পর্ষদ আমানতকারীদের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। ব্যাংক কোম্পানি আইনের অধীনে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করা হয়েছে।”
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মজিবুর রহমানকে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মত: দায়ী বিচারহীনতা ও নীতিগত অনিশ্চয়তা
সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন,
“বিদেশি বিনিয়োগকারীরা টাকা ঢেলেও সফল হতে না পারা আমাদের ব্যর্থতা। দীর্ঘদিনেও মামলার সমাধান না হওয়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঢিলেঢালা পদক্ষেপ সবই এ ব্যর্থতায় দায়ী। এই ঘটনাই বলে দেয় কেন বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসে না।”
ব্যবসাবান্ধব নীতির অভাবেই বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছে বিদেশিরা
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ব্যর্থতা কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের পতন নয়, বরং বাংলাদেশের ব্যাংক খাত ও বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতির প্রতিচ্ছবি। সুইস গ্রুপটির মতো আন্তর্জাতিক কোম্পানির বিনিয়োগ যদি এমনভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে, তাহলে ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ কতটা কঠিন হবে তা সহজেই অনুমেয়।
বিশ্লেষকদের মতে, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি এ সংকট থেকে শিক্ষা না নেয় এবং ব্যাংক খাতের সুশাসন নিশ্চিত না করে, তাহলে শুধু আইসিবি নয়—ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় বহু বিনিয়োগই হারিয়ে যাবে।