অর্থনীতি

যুক্তরাষ্ট্রের আরও ১০০ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কের সাম্প্রতিক উত্তেজনার মধ্যেই আশাব্যঞ্জক এক ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ভারস্যমূলক করতে বাংলাদেশ আরও ১০০টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিতে যাচ্ছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস এবং পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

সোমবার সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তরের (ইউএসটিআর) কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন এই প্রস্তাবনার কথা তুলে ধরেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এ উদ্যোগ শুধু প্রতীকী নয়, বরং বাস্তবভিত্তিক পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে স্থিতিশীল বাণিজ্য কাঠামো তৈরির এক প্রয়াস।

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক এবং বাংলাদেশের উদ্বেগ

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতিতে রয়েছে, তাদের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এই ঘোষণায় বাংলাদেশি রপ্তানিকারক ও ব্যবসায়ী মহলে উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনার পর আজ বাণিজ্য উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টা উভয়ে দুটি চিঠির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গঠনমূলক সমঝোতার আহ্বান জানিয়েছেন।

চিঠিতে কি বলা হয়েছে?

বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিনের পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) অনুযায়ী, উভয় দেশ পারস্পরিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পথে প্রতিবন্ধকতা দূর করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। এই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দিয়েছে যে, আমরা সবসময়ই গঠনমূলক সংলাপ ও সহযোগিতায় বিশ্বাসী এবং কোনো বাণিজ্য বাধা থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমে দূর করতে প্রস্তুত।

চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ বর্তমানে ১৯০টি পণ্যের ওপর শূন্য শুল্কহার প্রয়োগ করছে এবং নতুন করে আরও ১০০টি পণ্যকে এই তালিকায় যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এমন সব পণ্য যা যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকদের জন্য লাভজনক হতে পারে। বাংলাদেশ সরকার চায় এই পণ্যগুলোর রপ্তানির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের ভারসাম্য সৃষ্টি হোক।

শুল্ক বৈষম্যের চিত্র

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে চিঠিতে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশের সব রপ্তানি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর গড়ে ৬.১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। বিশেষ করে, কাঁচা তুলা ও লোহার স্ক্র্যাপের ওপর বাংলাদেশ শূন্য ও এক শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করে আসছে।

বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান তুলা আমদানিকারক দেশ। এই তুলাই দেশের পোশাক খাতের প্রাণ, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের বিশাল অংশ জোগান দেয়। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে বলে দাবি করা হয় চিঠিতে।

অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ

বাংলাদেশ সরকার আমদানি নীতিমালার হালনাগাদ, কাস্টমস প্রক্রিয়া সহজীকরণ, মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ, ট্রেডমার্ক ও পেটেন্ট সুরক্ষাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রকেও বাংলাদেশ একটি দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে দেখতে চায়।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য অটোমোবাইল নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করতে পারে। এতে করে দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের সম্ভাবনাও তৈরি হবে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রকে এলএনজি সরবরাহের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে।

বেসরকারি খাতের উদ্যোগ

চিঠিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করছে যেন তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন, গম, তুলা প্রভৃতি পণ্য বৃহৎ আকারে আমদানি করে। এর ফলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ভারসাম্য রক্ষা পাবে। একই সঙ্গে মার্কিন বেসরকারি খাতকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য সেবামূলক খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হতে বলা হয়েছে।

বাণিজ্য উপদেষ্টা তার চিঠিতে ব্যক্তিগতভাবে ইউএসটিআর-এর সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন এবং বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস এবং সরকারের পক্ষ থেকে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে আরও গতিশীল করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক আরোপ নিয়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সমালোচনা শুরু হয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি নিরসনের জন্য এই ধরনের একতরফা শুল্ক আরোপ বিশ্ব বাণিজ্যের ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ সরকার এমন পরিস্থিতিতে সংলাপ ও কূটনৈতিক পথে সমাধানের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা প্রশংসার দাবি রাখে।

বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের মতো অর্থনৈতিক পরাশক্তির সঙ্গে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্র যদি শুল্ক বিষয়ে নমনীয়তা দেখায়, তাহলে বাংলাদেশের পোশাক খাতসহ অন্যান্য রপ্তানি খাত নতুন গতি পাবে।

উপসংহার

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও ১০০ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব একটি কৌশলগত ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। বর্তমান বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রেক্ষাপটে পারস্পরিক সুবিধার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তোলাই টেকসই উন্নয়নের চাবিকাঠি। এখন দেখার বিষয়, যুক্তরাষ্ট্র এই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে কেমন প্রতিক্রিয়া জানায়। তবে যেভাবেই হোক, বাংলাদেশ স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—আলোচনা, কূটনীতি এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমেই এগিয়ে যেতে চায়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button