দেশের পুঁজিবাজারে গত সপ্তাহে বড় ধরনের দরপতন দেখা দিয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)-তে এক সপ্তাহে মোট শেয়ার ও ইউনিটের দর বৃদ্ধির তুলনায় পতনের সংখ্যা প্রায় ২১ গুণ বেশি হয়েছে। এর ফলে ডিএসইর প্রধান সূচকসহ সবগুলো মূল্যসূচক ৫ থেকে ৬ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। পাশাপাশি, এক্সচেঞ্জের দৈনিক গড় লেনদেনও প্রায় ২৭ শতাংশ কমে গেছে। সপ্তাহের শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকায়, যা আগের সপ্তাহের তুলনায় ১৬ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা বা ২.৪৫ শতাংশ কম।
শেয়ার দরপতনের পেছনে প্রভাবশালী কারণগুলো
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বড় দরপতনের পেছনে কয়েকটি নেতিবাচক কারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- পাঁচ ব্যাংকের শেয়ারের দাম শূন্য ঘোষণা
- বিএসইসির নতুন মার্জিন ঋণ সংক্রান্ত বিধান
- নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অনলাইনে ঘোষিত ‘লকডাউন’
বিশেষ করে মার্জিন ঋণ ও লকডাউন শেয়ার বাজারে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছে। লকডাউনের কারণে শেষ কার্যদিবসে ব্রোকারেজ হাউজগুলোতে বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি কম ছিল। অপরদিকে, মার্জিন ঋণ আতঙ্কে বিনিয়োগকারীরা কম দামে শেয়ার বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। এই সব মিলিয়ে গত সপ্তাহে ডিএসইতে বড় দরপতন হয়েছে।
ডিএসইর সূচক ও লেনদেনের চিত্র
গত সপ্তাহে ডিএসইতে মোট ৩৮৩টি কোম্পানি, মিউচুয়াল ফান্ড ও করপোরেট বন্ডের লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে:
- দর বেড়েছে: ১৭টি
- দর কমেছে: ৩৬৩টি
- দর অপরিবর্তিত: ৩টি
- লেনদেন হয়নি: ৩০টি
দরবৃদ্ধির তুলনায় ২১ গুণ বেশি সিকিউরিটিজের দরপতন হওয়ায়, প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ২৬৫ পয়েন্ট বা ৫.৩৪ শতাংশ কমে ৪,৭০৩ পয়েন্টে নেমেছে। আগের সপ্তাহে সূচকটি ৪,৯৬৮ পয়েন্টে ছিল।
নির্বাচিত কোম্পানির সূচক ডিএস-৩০ ৮৯ পয়েন্ট বা ৪.৬০ শতাংশ কমে ১,৮৫১ পয়েন্টে নেমেছে।
শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস ৬২ পয়েন্ট বা ৫.৯৯ শতাংশ কমে ৯৭৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
ব্রোকারেজ হাউস ইবিএল সিকিউরিটিজের তথ্য অনুযায়ী, সূচকের পতনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে:
- ইসলামী ব্যাংক
- বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস
- লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ
- রেনাটা পিএলসি
- ব্র্যাক ব্যাংক
ডিএসইতে দৈনিক গড়ে লেনদেন ৩৫৪ কোটি ৩৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা হয়েছে, যা আগের সপ্তাহের ৪৮৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার তুলনায় ২৬.৮৫ শতাংশ কম।
বাজার মূলধনের পতন ও খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ
গত সপ্তাহে ডিএসইর মোট বাজার মূলধন ৬ লাখ ৯০ হাজার ৯১৬ কোটি থেকে কমে ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকায় নেমেছে, অর্থাৎ ১৬,৯৪১ কোটি টাকার পতন।
খাতভিত্তিক লেনদেনের অবস্থান:
- প্রকৌশল খাত: মোট লেনদেনের ১৪.১৪%
- ওষুধ ও রসায়ন খাত: ১৩.৩৪%
- বস্ত্র খাত: ৯.৯৯%
- ব্যাংক খাত: ৮.৭৩%
- জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত: ৮.৩৩%
সব খাতেই নেতিবাচক রিটার্ন দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পতন হয়েছে জীবন বীমা খাতে (১৮.৪%), এরপর কাগজ ও মুদ্রণ খাত ১৭%, পাট খাত ১৫.৩%, মিউচুয়াল ফান্ড ১২.৮৭%, তথ্যপ্রযুক্তি খাত ১১.৪২%।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও দরপতন
দেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)-তে গত সপ্তাহে:
- সিএএসপিআই সূচক: ৩.৯৯% কমে ১৩,৪০১ পয়েন্টে
- সিএসসিএক্স সূচক: ৩.৪৪% কমে ৮,৩১৯ পয়েন্টে
সিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ৮০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, যা আগের সপ্তাহের ৯৭ কোটি ২০ লাখ টাকার তুলনায় কম। মোট ২৭২টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে:
- দর বেড়েছে: ২৯টি
- দর কমেছে: ২৩৬টি
- দর অপরিবর্তিত: ৭টি
বিশ্লেষকরা কি বলছেন?
বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, মার্জিন ঋণ সীমা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাজারে বিনিয়োগকারীদের মনোবল নষ্ট করেছে। লকডাউন ও কম উপস্থিতির কারণে এক্সচেঞ্জের কার্যক্রমে স্বাভাবিক চাহিদা কমেছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা অল্প সময়ে কম দামে শেয়ার বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। বিশেষ করে ব্যাংক, ওষুধ ও জীবন বীমা খাতের শেয়ারগুলোর দরপতন সূচকের পতনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে।
ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশন
বিশ্লেষকরা বলছেন, শেয়ার বাজারের এই ধরনের দমনের পর কিছুটা স্থিতিশীলতা আসতে পারে, তবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত বাজারে বড় কোনো উন্নতি আশা করা কঠিন। বিনিয়োগকারীদের জন্য এখন প্রয়োজন সতর্কতা অবলম্বন করা, লং-টার্ম ইনভেস্টমেন্টের দিকে মনোযোগ দেওয়া এবং ঋণজনিত ঝুঁকি এড়িয়ে চলা।
গত সপ্তাহে ডিএসই ও সিএসই উভয় বাজারেই দরপতন এবং লেনদেন কমে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ বেড়েছে। ডিএসইর বাজার মূলধন কমে ১৭ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, নতুন মার্জিন ঋণ বিধান, এবং লকডাউনের প্রভাব একসাথে মিলিয়ে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছে।
বিনিয়োগকারীরা চাইলে এখন শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার আগে খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ ও বাজার পরিস্থিতি খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
MAH – 13802 I Signalbd.com



