বাংলাদেশের কৃষি খাতে সার একটি অপরিহার্য উপাদান। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ সার আমদানি করে থাকে। সম্প্রতি কিছু গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সার আমদানিতে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে ভিত্তিহীন, মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছে।
অভিযোগ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া
শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫) কৃষি মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, কিছু সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের মতে, সার আমদানির পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয় এবং সর্বনিম্ন দরদাতার কাছ থেকেই সার সংগ্রহ করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়—
- ২০১৫ সালের নীতিমালা অনুযায়ী নন-ইউরিয়া সার আমদানির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন দরকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়।
- পূর্বে একাধিক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দামে সার সরবরাহ করলেও বর্তমান সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান থেকে সার কেনা হবে।
- এর ফলে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হয়েছে এবং অনিয়মের সুযোগ কমেছে।
আন্তর্জাতিক মূল্য তালিকা অনুসরণ
কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সার আমদানির সময় আন্তর্জাতিক বুলেটিন ‘আরগুস’ (Argus) ও ‘ফার্টিকন’ (Fertecon) এর মূল্য তালিকা অনুসরণ করা হয়।
- আন্তর্জাতিক বাজারে অবস্থান ও জাহাজ ভাড়ার কারণে দাম কিছুটা কমবেশি হতে পারে।
- তবে সেটিকে কেন্দ্র করে বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে, যা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
কোন কোন প্রতিষ্ঠান সার আমদানি করছে
চলতি অর্থবছরে সরকার সার আমদানির ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিয়েছে।
- প্রথম দফায় ১৩টি প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত দরে সার সরবরাহের অনুমতি পেয়েছে।
- পরবর্তীতে আরও ৬টি প্রতিষ্ঠানকে একই প্রক্রিয়ায় সুযোগ দেওয়া হয়।
মন্ত্রণালয়ের দাবি, অতিরিক্ত দর প্রস্তাব করা কিছু আমদানিকারকের প্রস্তাব বাতিল করা হয়েছে। ফলে সরকারি অর্থের অপচয় রোধ হয়েছে।
স্বচ্ছতার প্রশ্নে সরকারের অবস্থান
কৃষি মন্ত্রণালয় স্পষ্ট জানিয়েছে যে—
- সার আমদানির ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয়নীতির প্রতিটি ধাপ কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়।
- দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে মূল্য যাচাই পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে আন্তর্জাতিক মান বজায় থাকে।
- কোনো ধরনের দুর্নীতি বা অনিয়মের সুযোগ নেই।
এছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে এবং সরকারি বিধি-বিধান অনুযায়ী সার কেনা হয়। ফলে অভিযোগগুলো শুধুমাত্র বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশ্যে প্রচার করা হচ্ছে।
প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশের কৃষিতে সারের গুরুত্ব
বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তার বড় অংশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এই কৃষিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো সার।
- ধান, গম, ভুট্টা, সবজি, ডাল, তেলবীজসহ প্রায় সব ধরনের ফসল উৎপাদনে সারের ভূমিকা অপরিসীম।
- সময়মতো সঠিক পরিমাণ সার না পেলে কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- দেশীয় চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর সরকার বিপুল পরিমাণ সার আমদানি করে থাকে।
কেন সার আমদানি করতে হয়?
বাংলাদেশে সীমিত পরিমাণ ইউরিয়া সার উৎপাদিত হয়, তবে অন্যান্য ধরনের সার (যেমন—টিএসপি, এমওপি, ডিএপি) আমদানি করতে হয়। স্থানীয় উৎপাদন ও চাহিদার ফারাক মেটাতে সরকার প্রতিবছর বৈদেশিক বাজার থেকে সার আমদানির উদ্যোগ নেয়।
স্বচ্ছতার গুরুত্ব
সার আমদানির ক্ষেত্রে দুর্নীতি হলে তার প্রভাব সরাসরি পড়ে কৃষক ও কৃষি উৎপাদনের ওপর।
- দাম বেড়ে গেলে কৃষকদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।
- কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে।
- এতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
তাই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সরকারের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
কৃষি অর্থনীতিবিদরা মনে করেন—
- সার আমদানির ক্ষেত্রে সরকারের সর্বনিম্ন দর গ্রহণের নীতি ইতিবাচক পদক্ষেপ।
- এতে সরকারের বিপুল অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে এবং দুর্নীতির সুযোগ কমছে।
- তবে পুরো প্রক্রিয়াটি যেন আরও ডিজিটালাইজড হয়, তাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক বলেন, “আমাদের দেশের কৃষি খাত সার নির্ভর। তাই সার আমদানির প্রক্রিয়াটি যত বেশি স্বচ্ছ রাখা যাবে, কৃষক তত বেশি উপকৃত হবে।”
সার বিতরণ ব্যবস্থায় আধুনিকীকরণ
সরকার শুধু সার আমদানির দিকেই নয়, বিতরণ ব্যবস্থাতেও আধুনিকায়ন আনতে কাজ করছে।
- ডিজিটাল কুপন সিস্টেম
- কৃষক পর্যায়ে সরাসরি বিতরণ
- মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে তথ্য সরবরাহ
এসব উদ্যোগের মাধ্যমে কৃষকরা সঠিক সময়ে ন্যায্যমূল্যে সার পাচ্ছেন।
ভুয়া অভিযোগে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান
কৃষি মন্ত্রণালয় বলেছে, কিছু মহল ইচ্ছাকৃতভাবে সরকারের সাফল্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে মিথ্যা তথ্য প্রচার করছে।
- জনগণকে এসব ভুয়া প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
- প্রকৃত তথ্য জানার জন্য সবাইকে সরকারি ওয়েবসাইট ও অফিসিয়াল বিজ্ঞপ্তির ওপর নির্ভর করতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন টিকিয়ে রাখতে সার আমদানির বিকল্প নেই। এই প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই বলে সরকার দাবি করেছে। বরং সর্বনিম্ন দর ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করার ফলে অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে।
অভিযোগের সত্যতা নেই বলে কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জনগণকে ভুয়া প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হয়ে প্রকৃত তথ্য জানার আহ্বান জানিয়েছে।
MAH – 12789, Signalbd.comসার আমদানিতে দুর্নীতি: কৃষি মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা



