বাংলাদেশের স্বর্ণবাজারে আবারও উর্ধ্বগতি—বিশ্ববাজারের প্রভাব, মুদ্রাস্ফীতি ও বিনিয়োগকারীদের মনস্তত্ত্বে বড় ভূমিকা
বাংলাদেশের বাজারে আবারও বেড়েছে সোনার দাম। টানা চার দফা কমার পর নতুন করে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। ফলে দেশের বাজারে এক ভরি সোনার দাম ফের ২ লাখ টাকার ঘর ছাড়িয়েছে।
বুধবার (২৯ অক্টোবর ২০২৫) বাজুসের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম বাড়ায় স্থানীয় বাজারেও মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। নতুন দাম অনুযায়ী, সবচেয়ে ভালো মানের ২২ ক্যারেট সোনার এক ভরির দাম এখন ২ লাখ ২ হাজার ৭০৯ টাকা। বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) থেকে এই নতুন দাম কার্যকর হবে।
সোনার দামের সাম্প্রতিক ওঠানামা
চলতি মাসের শুরুতেই, অর্থাৎ ২০ অক্টোবর, এক ভরি সোনার দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেকর্ড ২ লাখ ১৭ হাজার ৩৮২ টাকায় উঠেছিল। কিন্তু পরবর্তী কয়েকদিনে টানা চার দফা দামে বড় ধরণের পতন ঘটে—মোট ২৩ হাজার ৫৭৩ টাকা কমে এক ভরি সোনার দাম নেমে আসে ১ লাখ ৯৩ হাজার ৮০৯ টাকায়।
তবে একদিন না যেতেই বাজুস নতুন করে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। অর্থাৎ বাজারে এখন এক অস্থির পরিস্থিতি—কখনও রেকর্ড দাম, আবার কখনও হঠাৎ কমে যাওয়া।
কেন বাড়ছে সোনার দাম?
বাজুস জানিয়েছে, স্থানীয় বাজারে তেজাবি সোনার (পিওর গোল্ড) দাম বাড়ায় এই সমন্বয় করা হয়েছে। তবে মূল কারণ আন্তর্জাতিক বাজার। বর্তমানে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স (প্রায় ৩১.১ গ্রাম) সোনার দাম ৪ হাজার মার্কিন ডলারের উপরে লেনদেন হচ্ছে, যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত, মার্কিন নির্বাচনের আগে বাজারে অস্থিরতা এবং মার্কিন ডলারের মান হ্রাস—এসব কারণেই বিনিয়োগকারীরা সোনার দিকে ঝুঁকছেন।
অর্থনীতিবিদদের মতে, “যখনই অর্থনীতি অনিশ্চিত থাকে, তখন মানুষ নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সোনা কেনে। এতে চাহিদা বাড়ে, ফলে দামও বেড়ে যায়।”
নতুন দামে স্বর্ণের মানভেদ অনুযায়ী মূল্য
বাজুসের নতুন বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, প্রতি ভরিতে সোনার দাম নিম্নরূপ নির্ধারণ করা হয়েছে:
- ২২ ক্যারেট সোনা: প্রতি ভরি ২,০২,৭০৯ টাকা
- ২১ ক্যারেট সোনা: প্রতি ভরি ১,৯৩,৫০৬ টাকা
- ১৮ ক্যারেট সোনা: প্রতি ভরি ১,৬৫,৮৬২ টাকা
- সনাতন পদ্ধতির সোনা: প্রতি ভরি ১,৩৭,৮৪৫ টাকা
রুপার দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। বর্তমানে রুপার দাম হলো:
- ২২ ক্যারেট রুপা: প্রতি ভরি ৪,২৪৬ টাকা
- ২১ ক্যারেট রুপা: প্রতি ভরি ৪,০৪৭ টাকা
- ১৮ ক্যারেট রুপা: প্রতি ভরি ৩,৪৭৬ টাকা
- সনাতন পদ্ধতির রুপা: প্রতি ভরি ২,৬০১ টাকা
বিশ্ববাজারে সোনার উর্ধ্বগতি: প্রেক্ষাপট ও বিশ্লেষণ
আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম গত কয়েক মাস ধরে ঊর্ধ্বমুখী। ২০২৫ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে লন্ডন বুলিয়ন মার্কেটে প্রতি আউন্স সোনার দাম ৪,০২০ ডলারে পৌঁছায়।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন,
১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুদের হার কমানোর সম্ভাবনা,
২. ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা,
৩. চীন ও ভারতের সোনার চাহিদা বৃদ্ধি,
৪. মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা,
এই চারটি কারণই মূলত সোনার দামের বৃদ্ধি ঘটিয়েছে।
সাধারণত, যখন ডলারের মান কমে যায়, তখন সোনার দাম বাড়ে। কারণ সোনা তখন বিকল্প নিরাপদ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাংলাদেশের বাজারে প্রভাব
বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম নির্ধারণে আন্তর্জাতিক বাজার ছাড়াও প্রভাব ফেলে আমদানি ব্যয়, ট্যাক্স, ডলার সংকট ও ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা।
বর্তমানে দেশে ডলারের ঘাটতি এবং আমদানি জটিলতার কারণে স্বর্ণ আমদানিতেও খরচ বেড়েছে। ফলে জুয়েলার্স সমিতি বাধ্য হয়ে স্থানীয় বাজারে দাম সমন্বয় করছে।
একজন স্বর্ণব্যবসায়ী বলেন,
“আমরা অনেক সময় আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দ্রুত দাম বাড়াতে বা কমাতে পারি না। কারণ বাজারে যে সোনা আছে, সেটি পুরনো দামে কেনা। তবে সাম্প্রতিক ডলার সংকটের কারণে আমাদের পক্ষে আগের দামে বিক্রি করা কঠিন হয়ে পড়ছে।”
সোনার বাজারে ভোক্তাদের প্রতিক্রিয়া
দামের এই অস্থিরতায় সাধারণ ক্রেতারা কিছুটা হতাশ। অনেকেই জানান, বিয়ের মৌসুম সামনে রেখে সোনা কেনার পরিকল্পনা করলেও এখন তা স্থগিত রাখছেন।
ঢাকার এক জুয়েলারি দোকানে দেখা গেছে, ক্রেতাদের ভিড় তুলনামূলক কম। বিক্রেতারা বলছেন, “যখন দাম বাড়ে, তখন মানুষ বিক্রি করতে আসে; কিন্তু নতুন ক্রেতা কমে যায়।”
অন্যদিকে, বিনিয়োগ হিসেবে সোনা কেনার প্রবণতা বেড়েছে। বিশেষ করে যারা শেয়ারবাজার বা রিয়েল এস্টেট খাতে আস্থাহীন, তারা এখন সোনার দিকে ঝুঁকছেন।
ইতিহাসে বাংলাদেশের স্বর্ণমূল্যের পরিবর্তন
বাংলাদেশে সোনার দাম গত এক দশকে প্রায় পাঁচগুণ বেড়েছে।
২০১৫ সালে ২২ ক্যারেট সোনার ভরি প্রতি দাম ছিল প্রায় ৪৩ হাজার টাকা।
২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫ হাজার টাকায়।
২০২৩ সালে এক লাফে এক লাখ ৫০ হাজার টাকায় পৌঁছে যায়।
আর ২০২৫ সালে এসে তা দ্বিগুণ হয়ে ২ লাখ টাকার ঘর ছাড়িয়েছে।
এই বৃদ্ধি শুধু আন্তর্জাতিক প্রভাব নয়, বরং দেশের মুদ্রাস্ফীতি, ডলার সংকট এবং বাজার নিয়ন্ত্রণের ঘাটতির ফলও বটে।
অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি
অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুবুল আলম বলেন,
“সোনার দাম বাড়া মানে অর্থনীতি খারাপ হচ্ছে—এটা পুরোপুরি সত্য নয়। অনেক সময় বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চিত সময়ে সোনা ধরে রাখে, কারণ সেটি দীর্ঘমেয়াদে নিরাপদ।”
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন,
“যদি সোনার দাম খুব দ্রুত বাড়ে, তাহলে তা মুদ্রাস্ফীতির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করতে পারে। কারণ মানুষ নগদ টাকা রেখে দিতে চায় না, বরং পণ্য কিনে ফেলে। ফলে বাজারে দ্রব্যমূল্য আরও বেড়ে যেতে পারে।”
ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
বিশ্ববাজারের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ সোনার দাম আরও বাড়তে পারে। মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কমালে এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অব্যাহত থাকলে দাম আরও উর্ধ্বমুখী থাকবে।
বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—
- বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা,
- সোনা আমদানিতে স্বচ্ছতা আনা,
- এবং মুদ্রানীতি এমনভাবে পরিচালনা করা যাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বজায় থাকে।
সোনার দাম বাড়া অনেকের জন্য চিন্তার বিষয় হলেও, এটি বৈশ্বিক অর্থনীতির বাস্তব প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশও সেই প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। বাজারের এই ওঠানামা সাময়িক হলেও, এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ ভোক্তা থেকে শুরু করে জুয়েলারি ব্যবসায়ী—সবাইয়ের জীবনে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা সোনা কিনতে চান, তারা হঠাৎ করে নয় বরং বাজার পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হবে। কারণ স্বর্ণের দাম এখন যেমন দ্রুত বাড়ছে, তেমনি অনিশ্চয়তার মধ্যেই আবার কমেও যেতে পারে।
MAH – 13549 I Signalbd.com



