
বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল দেশ। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) আজ মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) মোট ১৯৮৮ কোটি ৭ লাখ টাকার ১৩টি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একনেক বৈঠকে এই অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং প্রকল্প প্রস্তাবকারীরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পগুলোর দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন,
“প্রতিটি প্রকল্প যেন জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করে। বাজেটের প্রতিটি টাকা যেন সঠিকভাবে ব্যয় হয়। গুণগত মানে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না।”
প্রধানমন্ত্রী আরও উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করাই সরকারের মূল লক্ষ্য।
প্রকল্প অনুমোদনের আর্থিক কাঠামো
একনেক অনুমোদিত ১৩টি প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১,৯৮৮ কোটি ৭ লাখ টাকা।
এর মধ্যে—
- ৫৩ কোটি ২ লাখ টাকা আসবে বিদেশি ঋণ থেকে,
- ৫০ কোটি টাকা ব্যয় হবে সংশ্লিষ্ট সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে,
- আর বাকি পুরো অর্থ যাবে সরকারি কোষাগার থেকে।
এবারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে নতুন প্রকল্প ৩টি, সংশোধিত প্রকল্প ৭টি এবং মেয়াদ বাড়িয়ে ব্যয় অপরিবর্তিত রাখা ৩টি প্রকল্প রয়েছে।
কৃষি খাতে নতুন দিগন্ত
পিআরও-অ্যাক্ট বাংলাদেশ: রেজিলিয়েন্স স্ট্রেন্থেনিং থ্রু এগ্রি-ফুড সিস্টেমস ট্রান্সফর্মেশন ইন কক্সবাজার
এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে কক্সবাজার অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক জীবিকা আরও টেকসই হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় কৃষকদের সহনশীলতা বাড়াতে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এর আওতায় থাকবে—
- আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ,
- নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন,
- কৃষিপণ্য সংরক্ষণাগার স্থাপন,
- নারী কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ আয়বর্ধক উদ্যোগ।
দুর্যোগ ও অবকাঠামো উন্নয়ন
গ্রামীণ মাটির রাস্তা টেকসইকরণ প্রকল্প (২য় পর্যায়)
‘গ্রামীণ মাটির রাস্তাসমূহ টেকসইকরণের লক্ষ্যে হেরিং বোন বন্ড (এইচবিবি) করণ প্রকল্প’ তৃতীয়বার সংশোধিত আকারে অনুমোদন পেয়েছে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৫,০০০ কিলোমিটার গ্রামীণ রাস্তা টেকসইকরণ করা হবে। ফলে বর্ষা মৌসুমেও চলাচল সহজ হবে এবং কৃষিপণ্য পরিবহন ব্যয় কমবে।
পল্লী উন্নয়ন ও নগরায়ন
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আওতায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে—
- খুলনা বিভাগ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প (৩য় সংশোধিত)
- খুলনা বিভাগের নয়টি জেলায় পল্লী সড়ক, সেতু, কালভার্ট নির্মাণের মাধ্যমে যোগাযোগ উন্নত করা হবে।
- প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ব্যয় নির্ধারিত।
- জামালপুর শহরের নগর স্থাপত্যের পুনঃসংস্কার ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র উন্নয়ন প্রকল্প (৩য় সংশোধিত)
- জামালপুরের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংরক্ষণ, শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সংস্কৃতি কেন্দ্রের আধুনিকায়ন করা হবে।
- গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের অভ্যন্তরীণ রাস্তা, নর্দমা ও ফুটপাত নির্মাণ (৩য় সংশোধিত)
- গাজীপুরের ১ থেকে ৫ নম্বর জোনে রাস্তা উন্নয়ন, ড্রেন নির্মাণ ও ফুটপাত সংস্কারের কাজ হবে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়
উত্তরা লেক উন্নয়ন প্রকল্প (১ম সংশোধিত)
ঢাকার উত্তরা এলাকার লেক উন্নয়ন, সৌন্দর্যবর্ধন, ওয়াকওয়ে নির্মাণ এবং জলাধার সংরক্ষণের জন্য এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে।
এতে নাগরিকদের জন্য বিনোদন ও হাঁটার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় বাংলাদেশ চ্যান্সারি ভবন নির্মাণ
বাংলাদেশের কূটনৈতিক সক্ষমতা বাড়াতে ক্যানবেরায় একটি নতুন দূতাবাস ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
ভবনটিতে আধুনিক অফিস, কনস্যুলার সেবা কেন্দ্র, ও বাংলাদেশ সংস্কৃতি প্রদর্শনী গ্যালারি থাকবে।
সড়ক ও সেতু খাত
কিশোরগঞ্জ–পাকুন্দিয়া–মির্জাপুর টোক জেলা মহাসড়ক উন্নয়ন (১ম সংশোধিত)
এই প্রকল্পের মাধ্যমে কিশোরগঞ্জ জেলার গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করা হবে।
ফলে যান চলাচল সহজ হবে, দুর্ঘটনা কমবে এবং স্থানীয় বাণিজ্য বাড়বে।
শিল্প মন্ত্রণালয়
বিএসটিআই পরীক্ষাগার আধুনিকায়ন
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)-এর পদার্থ ও রসায়ন পরীক্ষণ ল্যাবরেটরি সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে।
এর ফলে পণ্যের গুণগত মান পরীক্ষার সক্ষমতা বাড়বে এবং রপ্তানির মান আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়
ঘোড়াশাল ৩য় ইউনিট রি-পাওয়ারিং প্রকল্প (২য় সংশোধিত)
দেশের অন্যতম বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ঘোড়াশালের ৩য় ইউনিট আধুনিকীকরণের কাজ দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন দক্ষতা ৫০% থেকে বেড়ে ৭০% পর্যন্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়
মানসিক হাসপাতাল, পাবনা–কে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ইনস্টিটিউটে রূপান্তর
এই প্রকল্পের মাধ্যমে পাবনার ঐতিহাসিক মানসিক হাসপাতালকে আন্তর্জাতিক মানের মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করা হবে।
নতুন ভবন, আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও গবেষণা ইউনিট স্থাপন করা হবে।
এটি বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্য খাতে এক বৈপ্লবিক উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়
রেল খাতেও দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে—
- বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের লেভেল ক্রসিং গেইটসমূহের পুনর্বাসন ও মান উন্নয়ন (৪র্থ সংশোধিত)
- বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল লেভেল ক্রসিং গেইটসমূহের পুনর্বাসন ও মান উন্নয়ন (৫ম সংশোধিত)
এই দুটি প্রকল্পের লক্ষ্য হলো দুর্ঘটনা রোধ ও নিরাপদ ট্রেন চলাচল নিশ্চিত করা। প্রায় ৬০০টিরও বেশি লেভেল ক্রসিং গেট আধুনিক যন্ত্রাংশ ও স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং সিস্টেমে রূপান্তর করা হবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রীর বক্তব্য
বৈঠক শেষে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের বলেন,
“আজকের একনেক সভায় অনুমোদিত প্রকল্পগুলো দেশের অবকাঠামো, কৃষি, স্বাস্থ্য ও শিল্পখাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে আঞ্চলিক বৈষম্য কমে যাবে এবং দেশের অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে।”
তিনি আরও জানান, সরকার এখন ‘গুণগত উন্নয়ন’-এর ওপর জোর দিচ্ছে— শুধু ব্যয় নয়, প্রকল্পের সুফল জনগণের ঘরে ঘরে পৌঁছাতে হবে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় নতুন গতি
বর্তমান সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে দৃঢ়ভাবে কাজ করছে। ২০২৫ সালের এই অনুমোদিত প্রকল্পগুলো সেই লক্ষ্য পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বিশেষ করে রেল, বিদ্যুৎ, কৃষি ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও শক্তিশালী করবে।
সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ
বিষয় | তথ্য |
---|---|
মোট প্রকল্প | ১৩টি |
মোট ব্যয় | ১,৯৮৮ কোটি ৭ লাখ টাকা |
নতুন প্রকল্প | ৩টি |
সংশোধিত প্রকল্প | ৭টি |
ব্যয় অপরিবর্তিত মেয়াদ বৃদ্ধি প্রকল্প | ৩টি |
অর্থায়নের উৎস | সরকারি কোষাগার, সংস্থার নিজস্ব তহবিল, বৈদেশিক ঋণ |
প্রধান খাত | কৃষি, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, রেল, বিদ্যুৎ, শিল্প |
একনেকের এই অনুমোদন বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় এক নতুন অধ্যায়।
সরকারের লক্ষ্য— অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও মানবিক উন্নয়নকে একসূত্রে গাঁথা রাখা।
প্রকল্পগুলো সঠিক সময়ে ও গুণগত মান বজায় রেখে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের উন্নয়নচিত্র আরও উজ্জ্বল হবে— এমনটাই আশা করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।
MAH – 13411 I Signalbd.com