বাংলাদেশ

বারনামাকে অধ্যাপক ইউনূস: নিজের নয়, জনগণের ইচ্ছায় সরকারপ্রধানের পদে বসেছি

Advertisement

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া তাঁর ব্যক্তিগত ইচ্ছা নয়; বরং জনগণের চাওয়ার প্রতিফলন। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বারনামাকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, দেশের মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল, আর তিনি কেবল তাদের পথ দেখানোর দায়িত্ব নিয়েছেন।

জনগণের ইচ্ছায় দায়িত্ব গ্রহণ

মালয়েশিয়া সফর শেষে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস স্পষ্টভাবে বলেন, “এটা আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়। জনগণ যে পরিবর্তন চেয়েছে, আমি শুধু তাদের সে পরিবর্তনের পথে এগিয়ে যেতে সহায়তা করছি।”

তিনি মনে করেন, একজন নেতার মতো নয় বরং একজন অভিভাবকের মতো তিনি এখন দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে পরিচালনা করছেন। এ দায়িত্বকে তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকে নয়, বরং দেশের প্রতি কর্তব্য হিসেবে দেখছেন।

গণঅভ্যুত্থান ও নতুন অধ্যায়

২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে দীর্ঘদিনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটে। একই বছরের আগস্টে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব দেন।

এ দায়িত্ব গ্রহণের আগে অধ্যাপক ইউনূস কখনো সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন না। ক্ষুদ্রঋণ ও দারিদ্র্য বিমোচনে তাঁর অবদান আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হলেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেওয়া ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপ।

চ্যালেঞ্জের মুখে অন্তর্বর্তী সরকার

অধ্যাপক ইউনূস স্বীকার করেন, সামনে পথ একেবারেই সহজ নয়। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত রাজনৈতিক উপাদানগুলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ব্যাহত করার চেষ্টা করছে। ফলে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা ও একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করাই তাঁর সরকারের প্রধান লক্ষ্য।

তিনি বলেন, “এখানে অসুবিধা অনেক। অনেকেই এটাকে ব্যাহত করতে চাইবে। তবে জনগণের সমর্থনই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার শক্তি।”

ভোটাধিকারের প্রশ্নে তরুণদের প্রত্যাশা

বাংলাদেশের তরুণ ভোটারদের দীর্ঘদিন ভোট দেওয়ার সুযোগ ছিল না। অধ্যাপক ইউনূস উল্লেখ করেন, অনেক তরুণ আছেন যারা গত ১০ থেকে ১৫ বছরেও ভোট দিতে পারেননি। এবার তারা প্রথমবারের মতো সেই সুযোগ পাবেন।

তিনি বলেন, “একজন তরুণ যখন ১৮ বছরে পৌঁছে ভোট দিতে চায়, অথচ বছরের পর বছর সে সুযোগ পায় না—এটা গণতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ ব্যর্থতা। এখন সেই প্রজন্মের হাতে প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার ফিরছে।”

মালয়েশিয়া সফর ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

 ১১ থেকে ১৩ আগস্ট মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের আমন্ত্রণে কুয়ালালামপুর সফর করেন অধ্যাপক ইউনূস। সফরকালে তিনি মালয়েশিয়ার নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করেন এবং রোহিঙ্গা সংকট ও আঞ্চলিক বাণিজ্যে সহযোগিতার আহ্বান জানান।

সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া একসঙ্গে কাজ করলে শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নয়, বৈশ্বিক ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে।”

অধ্যাপক ইউনূসের কর্মজীবনের মূল ভিত্তি

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ে দরিদ্র মানুষের সহায়তায় ক্ষুদ্রঋণের ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেন অধ্যাপক ইউনূস। তিনি মাত্র ২৭ ডলার ঋণ দিয়ে ৪২টি পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হওয়া এই উদ্যোগ ১৯৮৩ সালে পূর্ণাঙ্গ গ্রামীণ ব্যাংকে রূপ নেয়। ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১ কোটি ৭ লাখ ঋণগ্রহীতাকে সেবা দিয়েছে, যাদের ৯৭ শতাংশই নারী।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে অধ্যাপক ইউনূসের মূল লক্ষ্য হলো একটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা।

তবে তিনি স্বীকার করেন, গণতন্ত্রের পথে যাত্রা কখনোই সহজ নয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও বহিরাগত চাপে এ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তবুও তিনি আশাবাদী—জনগণের ইচ্ছাই হবে দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের চালিকাশক্তি।

অধ্যাপক ইউনূসের বক্তব্যে স্পষ্ট—অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব তাঁর কাছে ক্ষমতার আসন নয়, বরং জনগণের চাওয়াকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার দায়িত্ব। এখন প্রশ্ন হলো, দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতার পর বাংলাদেশের গণতন্ত্র কি সত্যিই একটি নতুন সূচনা পেতে যাচ্ছে?

এম আর এম – ০৮৮০, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button